শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে চমকে দেওয়া কে এই বামপন্থি নেতা দিসানায়েক?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:১০ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কায় গণ-বিক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন দেশটির বামপন্থি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) অ্যালায়েন্সের প্রার্থী অনুরা কুমারা দিসানায়েক।
রোববার সকাল পর্যন্ত গণনা শেষ হওয়া দশ লাখ ভোটের মধ্যে দিসানায়েকে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বলে শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রাথমিক ফলাফলে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন শ্রীলঙ্কার বর্তমান বিরোধী দলের নেতা সজিথ প্রেমাদাসা। দশ লাখ ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন প্রায় ২২ শতাংশ। আর এর পরেই রয়েছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।
এর আগে, শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভোটগ্রহণ শেষে রাতেই গণনা শুরু হয়। দেশটির এক কোটি ৭০ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তারা।
শ্রীলঙ্কার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ৩৯ জন। তবে ভোট গ্রহণ শেষে তিনজনের নাম আলোচনায় শোনা যাচ্ছিল। তাদের একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। একজন বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা ও গুপ্তহত্যার শিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা। এবং আরেকজন এই অনুরা কুমারা দিশানায়েক।
তবে সবাইকে পেছনে ফেলে মার্কসবাদী দিশানায়েক-ই হয়ত শ্রীলঙ্কার আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন ।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা করতে গিয়ে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোটের বেশি পেতে সক্ষম হননি, ফলে গণনা দ্বিতীয় দফায় পৌঁছেছে।
নির্বাচন কমিশন এখন রাষ্ট্রপতির জন্য ভোটারদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পছন্দের ভোট গণনা করবে—ভোটারদের পছন্দের ক্রমানুসারে তিনজন প্রার্থীকে চিহ্নিত করতে বলা হবে।
প্রথম দফায় বামপন্থী রাজনীতিবিদ আনুরা কুমার দিসানায়েক ৩৯.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন। বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ৩৪.০৯ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দিশানায়েকের উত্থানের গল্প যেন রূপকথার মতো। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া দিশানায়েক ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি শ্রীলঙ্কার দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনের কঠোর সমালোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের চেয়ে নিজেকে ভিন্ন হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। যদিও জেভিপির মাত্র তিনটি আসন রয়েছে ২২৫ সদস্যের শ্রীলঙ্কার সংসদে, তবুও সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোতে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
১৯৯৫ সালে দিশানায়েক জেভিপির পলিটব্যুরোতে যোগ দেন। ২০০০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি কৃষি, প্রাণীসম্পদ, ভূমি ও সেচ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী হুইপ হিসেবে কাজ করেন। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৭তম জাতীয় কনভেনশনে তিনি জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা তাকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
ভোটে দিশানায়েক এগিয়ে কেন?
জেভিপির সংসদে সীমিত প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও, দিশানায়েকের ভোটে এগিয়ে থাকার পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে মাহিন্দা রাজাপাকসে পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। তবে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের পর ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসে, যার ফলে গোতাবায়া রাজাপাকসে পালাতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে দিশানায়েকের মতো নতুন নেতাদের উত্থান সহজ হয়েছে।
সমালোচকরা জানান, মাহিন্দা যত ক্ষমতাশালী হয়েছেন তার পরিবারের ক্ষমতাও ততই বেড়েছে। তিনি তার ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অপর দুই ভাই বাসিল ও চামালকে যথাক্রমে অর্থমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকারের পদে বসান।
তবে বেশ কয়েকটি সরকারি নীতি মুখ থুবড়ে পরায় দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয়। ক্রমে এর পরিণতিতে ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের সূচনা হয়। কয়েক মাসব্যাপী চলা এই বিক্ষোভ, সিংহলি ভাষায় যাকে বলে 'আরাগালয় (গণবিক্ষোভ)', ২০২২ সালের জুলাইয়ে নাটকীয় ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এর ফলে গোতাবায়া অপমানজনকভাবে পালাতে বাধ্য হন।
নামাল রাজাপাকসে, মাহিন্দা রাজাপাকসের পুত্র, যাকে একসময় ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে ভাবা হতো, তিনিও এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যর্থ হয়েছেন। তরুণ প্রজন্ম তাকে ব্যর্থ রাজনৈতিক পরিবারের অংশ হিসেবে দেখে।
গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের পতনের পর, দিশানায়েক একটি বিকল্প নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেন। তার নেতৃত্বে জেভিপি এবং ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোট শ্রীলঙ্কার জনগণের আস্থা অর্জন করে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দিশানায়েকের রাজনৈতিক জীবন শুরুতে, জেভিপি দলটি দুইবার শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করে। কিন্তু বিদ্রোহগুলোর ব্যর্থতার পর দিসানায়াকে এবং তার দল শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভেতরে থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করেন। তিনি শ্রীলঙ্কার পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান নেন, বিশেষত রাজাপাকসে পরিবারের দীর্ঘকালীন আধিপত্যের বিপরীতে।
দিশানায়েক তার সৎ এবং সোজাসাপ্টা রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার জন্য নয়, বরং সমাজের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য লড়াই করার তার সংকল্প তাকে আলাদা করে তুলে। দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান, আর্থিক ন্যায়বিচার এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে।
দিশানায়েক নিজেকে একজন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি কোনো ধনী বা ক্ষমতাশালী পরিবারেরও সদস্য নন, যা তাকে অনেক ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
বছর দুয়েক আগে শ্রীলঙ্কা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল, যখন দেশটির অর্থনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছায়। বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা সরকারকে অসহায় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে, নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর যে গুরুদায়িত্ব থাকবে, তা স্পষ্ট।