Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

মার্কিন কংগ্রেসে কতটুকু সত্য ভাষণ দিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:৩৩ পিএম

মার্কিন কংগ্রেসে কতটুকু সত্য ভাষণ দিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী

মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশনে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেওয়া ভাষণ ছিল আক্রমণাত্মক মন্তব্যে ভরা। ভাষণে ছিল প্রায় দশম মাসে পদার্পণ করা গাজা যুদ্ধ নিয়ে নানা দাবিও।

ভাষণে এ যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ বারবারই টেনেছেন নেতানিয়াহু। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আদালতের কৌঁসুলিরা গত মে মাসে নেতানিয়াহু, তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

কংগ্রেসে নেতানিয়াহু তার ভাষণে যেসব দাবি করছেন, সেগুলোর কয়েকটি এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই করে দেখেছে দ্য গার্ডিয়ান। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো—

গাজাবাসীর জন্য খাদ্য সহায়তা

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কৌঁসুলি লজ্জাজনকভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজার বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে না খাইয়ে রাখার অভিযোগ করেছেন। এটা নিরেট ও ডাহা মিথ্যা। এটা পুরোপুরি বানোয়াট কথা। ইসরাইল গাজায় ত্রাণবাহী ৪০ হাজার ট্রাক ঢুকতে দিয়েছে। এসব ট্রাকে ছিল অর্ধমিলিয়ন (৫ লাখ) টন খাদ্যসামগ্রী।

তবে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর গাজায় ত্রাণবাহী ২৮ হাজার ১৮টি ট্রাক প্রবেশ করেছে। যেসব পথ দিয়ে গাজায় এসব ট্রাক ঢুকেছে, সেসবের মধ্যে রাফা ক্রসিং ছিল না। মে মাসের শুরুতে ইসরাইলি বাহিনী এ ক্রসিংয়ের দখল নেয়। এতে উপত্যকাটির দক্ষিণাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহে ব্যাপকভাবে বিঘ্ন ঘটে।

ওই সময়ের পর থেকে মাত্র ২ হাজার ৮৩৫টি ট্রাক কেরেম শ্যালম ক্রসিং দিয়ে গাজার দক্ষিণে ও উত্তরের ইরেজ এলাকায় প্রবেশ করে। এতে প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ করা গেছে অতি সামান্য ত্রাণ।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ত্রাণসামগ্রী প্রবেশে বাধা দেওয়া ও ত্রাণ সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ করেছে ত্রাণ সংগঠনগুলো।

অক্সফামের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক স্যালি আবি খলিল গত মার্চে বলেছেন, গাজায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতা চালানোর পথ সুগম করতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ শুধু ব্যর্থই হয়নি; বরং সক্রিয়ভাবে বাধা দিয়েছে।

ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৯ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজারো মানুষের মরদেহ চাপা পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করা বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সংগঠন ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন’ চলতি বছরের শুরুর দিকে গাজা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে বলে সতর্ক করে দেয়। জুন মাসে সংগঠনটির দুর্ভিক্ষ পর্যালোচনা কমিটি জানায়, উত্তর গাজায় ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা অনুমতি পাওয়ায় ঠিক ওই সময় উপত্যকাটিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অবশ্য, সংগঠনটি বলেছে, গাজা দুর্ভিক্ষের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি এখনো বিপর্যয়কর।

বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার বেসামরিক লোকজনকে নিশানা বানাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আইসিসির কৌঁসুলি। তিনি কী বলছেন? বেসামরিক ফিলিস্তিনিরা যাতে নিরাপদ স্থানে সরে যান, সে জন্য আইডিএফ (ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী) লাখ লাখ প্রচারপত্র ফেলেছে, লাখ লাখ খুদে বার্তা পাঠিয়েছে ও হাজার হাজার ফোন কল করেছে।

বাস্তবে, আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের লক্ষ করে কিছু প্রচারপত্র ফেলেছে বা বার্তা পাঠিয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল, কোনো এলাকায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলার অভিপ্রায় সম্পর্কে ফিলিস্তিনিদের অবগত করা। কিন্তু বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হামলার শিকার হওয়া থেকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে এ পদক্ষেপ। চলতি সপ্তাহেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। ইসরাইল খান ইউনিস থেকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের। সেখানে আনুমানিক ৪ লাখ মানুষের বসবাস।

এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক দপ্তর ওসিএইচএ বলেছে, ইসরাইলি বাহিনীর হামলা চলার প্রেক্ষাপটে এলাকা খালি করার ওই নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশে ফিলিস্তিনিদের কোন স্থান থেকে কখন সরে যেতে হবে বা কোথায় যেতে হবে, সেসব বিষয়ে উল্লেখ করা নেই। আবার, খালি করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট এলাকার ভেতরে ও বাইরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন ইসরাইলি সেনারা।

ওসিএইচএর প্রধান আন্দ্রিয়া ডি ডোমিনিকো এ মাসের শুরুতে বলেন, আইডিএফের এলাকা খালি করার নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হলো, গাজার লোকজনকে বারবার পালিয়ে যেতে বাধ্য করা। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশ অন্তত একবার ও অনেকে ১০ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরাইলি বাহিনী কিছু এলাকা ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ইতিপূর্বে নিরাপদ ঘোষিত এলাকায়ও বিমান হামলা চালাতে দেখা গেছে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর হিসাবে গাজা উপত্যকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা ইসরাইল ‘খালি করার নির্দেশ দিয়েছে বা সেসব স্থান যাওয়ার অযোগ্য বলে চিহ্নিত’ করেছে।

ফিলিস্তিনি জনগণ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো বারবার বলছে, গাজায় কোনো নিরাপদ স্থান নেই। গণহারে খালি করার এ নির্দেশকে বিভ্রান্তিকর বলে আখ্যায়িত করেছে ওসিএইচএ। সংগঠনটি বলেছে, বেসামরিক লোকজন যাতে পালাতে পারেন সে জন্য ইসরাইলি বাহিনী একদিকে নির্দেশনা দিচ্ছে, অন্যদিকে একই স্থানে বা যে স্থান হয়ে তারা পালিয়ে যেতে পারেন, সেখানে হামলা জোরাল করছে।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট হোটেলে অবস্থান করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল বুধবার ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা হোটেলটির সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন

হামাসের সঙ্গে সমঝোতা

ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, হামাস আত্মসমর্পণ করলে, নিরস্ত্র হলে ও সব জিম্মিকে ফিরিয়ে দিলে গাজায় যুদ্ধ শেষ হতে পারে আগামীকালই। কিন্তু হামাস যদি তা না করে, তবে তাদের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা, গাজায় তাদের শাসনের অবসান ঘটানো ও আমাদের সব জিম্মিকে দেশে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত ইসরাইল লড়াই চালিয়ে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে, নেতানিয়াহুর ভাষণে গাজায় এমনকি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার বিষয়েও কোনোকিছু উল্লেখ নেই; যদিও তিনি সমঝোতা চলছে বলে জানিয়েছেন। গত মাসে ইসরাইলি বাহিনী যে অভিযান চালিয়ে চার জিম্মিকে উদ্ধার ও অন্তত ২৭৪ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, সেই ঘটনার প্রশংসা করেছেন তিনি।

নেতানিয়াহু ভাষণে ‘পুরোপুরি বিজয়’ অর্জন করার অঙ্গিকার করেছেন। বলেছেন, একমাত্র সামরিক চাপই হামাসকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সইয়ে রাজি করাতে পারে। তিনি জোর দিয়ে আরও বলেন, ইসরাইলি বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে গাজায় আছে এবং এমনকি, সাময়িকভাবে বৈরিতা অবসানে রাজি হলেও লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তারা।

সাবেক ইসরাইলি মধ্যস্থতাকারী গারশন বাস্কিন চলতি মাসে বলেছেন, ‘৯ মাসের বেশি সময় ধরে সামরিক চাপের ফলাফল হলো, শুধু জিম্মি হত্যা ও অনেক বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা। এখনই চুক্তি করুন।’ 

তিনি বলেন, সমঝোতা প্রচেষ্টায় অন্যান্য ইসরাইলি মধ্যস্থতাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এ প্রক্রিয়াকে জনগণের সামনে আনা উচিত; যাতে সবাই জানতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীই এ চুক্তির বাঁধা।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এর জবাবে ওই দিন থেকেই ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। এ হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৯ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজারো মানুষের লাশ চাপা পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম