সংস্কারপন্থির জয়, বদলে যাবে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৬ পিএম
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের পর শনিবার ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান। বেশ কয়েক বছর পর ইরানের মসনদে বসলেন দেশটির সংস্কারপন্থি কোনো নেতা। ইরানের ক্ষমতা বেশ কয়েক বছর ধরে রক্ষণশীলদের হাতে রয়েছে।
এজন্য পেজেশকিয়ানের জয়ে আশার আলো দেখছেন সংস্কারপন্থিরা। তবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নতুন প্রেসিডেন্টের অধীনে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তন হবে কিনা- এ নিয়েই চলছে জল্পনা-কল্পনা।
অনেকেই ধারণা করছেন, ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে যে নীতিতে রাষ্ট্রপরিচালনা করছে তাতে নতুন প্রেসিডেন্ট এলেও দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব থাকে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ওপর। তবে মাসুদ পেজেশকিয়ান বরাবরই ইরানের বেশ কিছু নীতি পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল যে ছয়জনের প্রার্থিতাকে অনুমোদন করেছেন, তাদের মধ্যে পেজেশকিয়ানই একমাত্র সংস্কারপন্থি নেতা। সংস্কারপন্থি নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের উত্তরসূরি হিসাবেও বিবেচিত তিনি। তাকে এবার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও সমর্থন জানিয়েছেন। পেজেশকিয়ান নির্বাচিত হলে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন বলে আগেই ধারণা করছেন তার সমর্থক। পেজেশকিয়ান একাধিকবার দেশটির সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন।
ইরানের নৈতিকতা পুলিশের সমালোচনাও করেছেন তিনি। তার এক বক্তৃতায়, ইরানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হয়েছিল তার সমালোচনাও করেছেন তিনি। নির্বাচনের প্রচারণায় পেজেকশিয়ান ইরান থেকে হিজাব আইন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এবং পশ্চিমের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর জন্য পুনরায় পরমাণু চুক্তিও পুনর্বিবেচনা করবেন তিনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন প্রেসিডেন্ট এলেও ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাদের মতে, মাসুদ পেজেশকিয়ান নির্বাচনে জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি দেশের দিক পরিবর্তন করার ক্ষমতা পাবেন। কারণ ক্ষমতা পরিবর্তনের লাগাম থাকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ওপর।
১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনি। ইরানের যেকোনো বিষয়ে মূল সিদ্ধান্ত নেন তিনিই। এছাড়া তিনিই দেশটির প্রধান ও কমান্ডার ইন চিফ। দেশটির সরকারি পুলিশ ও নীতিপুলিশের কর্তৃত্বও খামেনির হাতে। ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) নিয়ন্ত্রণও আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির হাতে। আইআরজিসির দায়িত্ব ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা। ইরানের প্রেসিডেন্ট দেশটির শীর্ষ নির্বাচিত কর্মকর্তা। তবে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পরই তার অবস্থান। সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব থাকে সর্বোচ্চ নেতার ওপরই।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে তার সীমিত ক্ষমতা থাকলেও ইরানের অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে একজন সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্টকে ইরানের পার্লামেন্টে আধিপত্য বিস্তারকারী অতি-রক্ষণশীল শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘরে ও আন্তর্জাতিকভাবে পররাষ্ট্রনীতি সামলাতে কঠিন সময় পার করছে ইরান। তাই নতুন প্রেসিডেন্টকে এসব ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। এ ছাড়া ইরানে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি চলছে। দেশটিতে এখন রেকর্ড ৪০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি। এতে জনসাধারণকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। যদিও দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই মুদ্রাস্ফীতি স্বল্পস্থায়ী হবে। অন্যদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তেহরান এখনো তাদের অপরিশোধিত তেল চীনে বিক্রি করছে। তবে দেশটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই অর্থনৈতিক অবস্থা অনুকূলে আনার জন্য পেজেশকিয়ানকে ভালোই কাঠখড় পোড়াতে হবে। এ ছাড়া দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সঙ্গে মতৈক্য চলছে। এটিও ভালোভাবে সামাল দিতে হবে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টকে। একই সঙ্গে ইরানের তরুণ সমাজ দেশটিতে সংস্কার চান। ২০২২ সালে মাশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে দেশটিতে সরকার কাঁপানো বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভ দমাতে শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যার অভিযোগ উঠে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই সমাজ সংস্কারের জন্যও পেজেশকিয়ানকে দক্ষতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সংস্কারপন্থি পেজেশকিয়ান বরাবরই দেশটির সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছেন।
উল্লেখ্য, শুক্রবার সকাল ৮টা (স্থানীয় সময়) থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে দেশটির দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ। এর আগে ২৮ জুন ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু চার প্রার্থীর কেউই ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন প্রধান দুই প্রার্থী- ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ঘনিষ্ঠ সাঈদ জালিলি এবং সংস্কারপন্থি প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, শুক্রবারের নির্বাচনে জালিলির চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন পেজেশকিয়ান। পেজেশকিয়ান পেয়েছেন এক কোটি ৬৩ লাখ ভোট। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী জালিলি পেয়েছেন এক কোটি ৩৫ লাখ ভোট।