ভোট পড়ে ১০০ শতাংশ, যেভাবে নির্বাচন হয় কিমের দেশে
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৪৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
চীনের পূর্ব প্রান্তে জাপান সাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটি ছোট দেশ উত্তর কোরিয়া। দেশটিতে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু থাকায় রাজনৈতিকভাবে দেশটি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। দেশটির মানুষ কিমের কথাতেই ওঠেন এবং বসেন। কারণ কোরিয়ার প্রশাসক কিম জং উন। বংশ পরম্পরায় তার পরিবার দেশ শাসন করছে। তার ‘রাজত্বে’ তার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
তবে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলেও দেশটিতে রয়েছে নির্বাচন। রয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দলও। ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারপার্সন দেশটির দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক কিম নিজেই। সেটাই দেশের বৃহত্তম পার্টি। তবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং চন্ডোয়িস্ট চঙ্গু পার্টিও রয়েছে।
প্রতি চার থেকে পাঁচ বছর অন্তর উত্তর কোরিয়াতেও ভোট হয়। দেশের আইনসভা সুপ্রিম পিপল্স অ্যাসেম্বলি (এসপিএ)-এর নিয়ন্ত্রক সেই ভোটের মাধ্যমেই নির্বাচিত হন।
কিমের দেশে কেউ কখনও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে, প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে চলতে চাইলে কঠোর পদক্ষেপ নেয় প্রশাসন। ক্ষমতার জোরে দমিয়ে দেওয়া হয় জনগণের কণ্ঠ। সংবাদমাধ্যমও সরকার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।
শুধু তা-ই নয়, দেশটিতে এই এসপিএ নির্বাচনে ভোটার সাধারণ নাগরিকেরাই। দেশের মানুষই প্রতি বার নির্বাচনের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের নিজের ভোট দেন। এসপিএ নির্বাচনের পদ্ধতিতেই হয় কিছু স্থানীয় স্তরের নির্বাচনও।
ভোট দিয়ে শাসক নির্বাচন করা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় গণতন্ত্র নেই। তাই সেখানে নির্বাচন হলেও তার পদ্ধতি আর পাঁচটা দেশের চেয়ে আলাদা। সেখানকার মানুষ ভোট দেন, কিন্তু আদৌ কোনও অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।
দেশটির জাতীয় আইনসভা এসপিএ-র নির্বাচন হয় প্রতি চার বছর অন্তর। স্থানীয় স্তরের নির্বাচনগুলো হয় পাঁচ বছর পর পর। প্রতি ক্ষেত্রেই ভোট হয় ব্যালট পেপারে।
কিমের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল ভোটের হার। প্রতি বার প্রত্যেক নির্বাচনে ভোটারদের প্রায় ১০০ শতাংশ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দেশের প্রায় সবাই ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।
নির্বাচনে ভোটারদের ১০০ শতাংশ উপস্থিতি অবশ্য পুরোটাই স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কারণ, দেশটিতে সবাইকে বাধ্যতামূলক ভোট দেওয়ার জন্য নির্দেশ রয়েছে সরকারের। কেউ ভোট না দিতে চাইলে তার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। তাই ভোট না দেওয়ার ঝুঁকি নেন না কেউ।
২০১৪ সালে কোরিয়ার এসপিএ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৯৯.৯৭ শতাংশ। দু’এক জন ভোটার ভোট দিতে পারেননি। প্রতি বছরই শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনও কারণে কেউ না কেউ ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকেন। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় অনেক সময়ে সেই পরিসংখ্যানও ঢাকা পড়ে যায়। কোরিয়ায় ভোট নিয়ে প্রচলিত কথা— এখানে ভোটের দিন কেউ মরে না, কারও অসুখ করে না।
১৭ বছর এবং তার বেশি বয়সি সব নাগরিক ভোট দিতে বাধ্য থাকেন কিমের দেশে। প্রশাসন থেকে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, সকাল সকাল বুথে পৌঁছে যাওয়ার। সকলেই সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রের বাইরে লাইন দিলে সারা দিনে ভোটের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। সেটাই সরকারের উদ্দেশ্য।
দেশটির ভোটে কোনও গোপনীয়তা নেই। একটি করে ব্যালট পেপার প্রতি ভোটারকে দেওয়া হয়। সেখানে এক জন প্রার্থীরই নাম থাকে। তাকেই সকলকে ভোট দিতে হয়। তিনিই নির্বাচিত হন।
খাতায়কলমে নিয়ম অনুযায়ী, ভোটারেরা চাইলে ব্যালটে থাকা ওই একটি নামের পাশে কাটা চিহ্ন দিয়ে প্রার্থীর প্রতি নিজের অসম্মতি জানাতে পারেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয় না। ব্যালটে কেউ কলমও ছোঁয়ান না। প্রত্যেকেই প্রকাশ্যে ব্যালটটি গ্রহণ করেন এবং নির্দিষ্ট ভোটবাক্সে ফেলে দেন।
কেউ এই ভোটপ্রক্রিয়ার অন্যথা করলে বা গোপনে ভোট দিতে চাইলে আলাদা করে তাকে চিহ্নিত করে রাখেন প্রশাসনিক কর্মীরা। পরে তাকে শাস্তিও পেতে হয়।
খাতা কলমে তিনটি আলাদা দল হলেও বাস্তবে এই তিন দল আসলে একই। একসঙ্গে এদের জোটের নাম ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর রিইউনিফিকেশন অফ কোরিয়া। ভোটের সময়ে ৮৭.৫ শতাংশ কেন্দ্রে ওয়ার্কার্স পার্টি, ৭.৪ শতাংশ কেন্দ্রে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ৩.২ শতাংশ কেন্দ্রে চন্ডোয়িস্ট চঙ্গু পার্টি প্রার্থী দেয়।
কোরিয়ার নির্বাচন একটি উৎসবের মতো। ভোট দিয়ে বেরিয়ে ভোটকেন্দ্রের বাইরে বাধ্যতামূলক ভাবে ভোটারদের উৎসব পালন করতে হয়। সরকারের জয়ধ্বনি দিয়ে নাচতে হয় ভোটারদের।
দেশের যে কোনও অনুষ্ঠান কিংবা সরকারি কর্মসূচিতেই এই জয়ধ্বনি বাধ্যতামূলক। সরকারের প্রশংসা করে তার সাফল্যের খুশিতে আনন্দ প্রকাশ করতে হয় দেশের মানুষকে। এটাই সেখানকার নিয়ম।
নির্বাচন প্রক্রিয়াকে জনগণনার মাধ্যম হিসাবেই দেখে কোরিয়ার প্রশাসন। ভোটের হার দেখে কারা ভোট দিলেন না চিহ্নিত করা হয়। কেন তারা ভোট দিলেন না, সেই কারণ খুঁজে বার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। উত্তর কোরিয়া থেকে চীনে বা দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। যদিও তা বেশ বিরল।
স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন এলাকায় মেয়র বা গভর্নর নির্বাচনের জন্য স্থানীয় নির্বাচন হয় দেশটিতে। ১৯৯৯ সাল থেকে তা শুরু হয়েছে। একই পদ্ধতিতে জনগণের ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। যদিও তাঁদের নির্বাচিত না বলে ‘নিযুক্ত’ বলার পক্ষপাতী অনেকে।
উত্তর কোরিয়ার শাসনব্যবস্থা, কিমের বিভিন্ন নীতির মতোই নানা সময়ে নানা ভাবে সমালোচিত হয়েছে সে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াও। এই ভোটকে ‘দেখানো’ ভোট বলে থাকেন সমালোচকরা। তাদের মতে, এই ধরনের নির্বাচনের আদৌ কোনও অর্থ নেই। নির্বাচন না হলেও সরকারের কোনও সমস্যা হত না।
তবু প্রতি চার বছর অন্তর জাতীয় আইনসভার নির্বাচন এবং পাঁচ বছর অন্তর স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের সাক্ষী থাকে উত্তর কোরিয়া। কিমের কথাই সেখানে ‘বেদবাক্য’। বছরের পর বছর ধরে সেই রেওয়াজ চলছে।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।