ধ্বংসস্তূপের মাঝেই ভালোবাসার ফুল ফোটান ইউক্রেনীয় যুগল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম

অনবরত রুশ বোমা হামলায় দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনীয় শহর মারিওপোলের সড়কগুলো যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং এর খোলা জায়গাগুলো পরিণত হয় কবরস্থানে। তবে সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝে কয়েক মিটারের ভূগর্ভেই যেন একটি ভালোবাসার ফুল ফোটান এক ইউক্রেনীয় যুগল।
ঘটনাটি ২০২২ সালের বসন্তের। যখন রুশ বাহিনী শহরটির চূড়ান্ত শক্ত ঘাঁটি বিশাল আজভস্টাল স্টিল কারখানাকে ঘিরে ফেলে। সেখানেই অনেকের সঙ্গে শিল্প-কারখানাটির একটি প্ল্যান্টের বাঙ্কারে আশ্রয় নেন ৩৩ বছর বয়সি ভ্যালেরিয়া সুবোটিনা।
বাঙ্কারটির বর্ণনা দেওয়া ভ্যালেরিয়ার ভাষায়, ‘আপনি একটি আধা ধসে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে যান, প্যাসেজ এবং টানেলের মধ্য দিয়ে যান এবং আরও নিচে যান। অবশেষে আপনি একটি কংক্রিট কিউবের মতো একটি ছোট্ট ঘরে পৌঁছে যাবেন।’
ওই বাঙ্কারে সৈন্য এবং বেসামরিক লোকজন একসঙ্গেই অবস্থান করতেন। তাদের সঙ্গে থাকা ভ্যালেরিয়া সেনাবাহিনীর আজভ ব্রিগেডের প্রেস অফিসার হিসাবে কাজ করছিলেন। রাশিয়ার মাসব্যাপী অবরোধের ভয়াবহতার কথা তিনিই বিশ্ব মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন।
ওই বাঙ্কারেই ছিলেন ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তা ৩৪ বছর বয়সি তার বাগদত্তা অ্যান্ড্রি সুবোটিন। যিনি আজভস্টালের ওই প্ল্যান্টকে রক্ষা করেছিলেন।
যাইহোক, এই যুগল মূলত একে অপরকে খুঁজে পান তাদের কর্মসূত্রেই, অবরোধের প্রায় তিন বছর আগে মারিওপোলের বর্ডার গার্ড এজেন্সিতে কাজ করার সময়। সেখানে ভ্যালেরিয়ার সঙ্গে অ্যান্ড্রির যখন দেখা হয়, প্রথম দেখাতেই তাদের প্রেম হয়ে যায়।
ভ্যালেরিয়ার ভাষায়, ‘অ্যান্ড্রি আসলেই স্পেশাল মানুষ ছিলেন, তার কাছাকাছি থাকাটা ছিল খুবই উপভোগ্য। সে সর্বদা সদয় ছিল এবং যে কারো জন্যই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত।'
অ্যান্ড্রি সম্পর্কে ভ্যালেরিয়া আরও বলেছেন, ‘সে একজন আশাবাদী মানুষ ছিল। সে জানত কিভাবে সহজেই খুশি হতে হয় এবং রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া, হাসি, বন্ধুদের সঙ্গ- এরকম ছোট ছোট বিষয়েই আনন্দ খুঁজে পেত। আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হয়, আমি বুঝতে পারি যে, অ্যান্ড্রি অন্যদের থেকে খুবই আলাদা।'
এর তিন মাসের মধ্যে, তারা মারিওপোলে একটি বাগানসহ ছোট একটি একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। একসঙ্গে দাম্পত্য জীবন গড়তে শুরু করেন।
ভ্যালেরিয়ার বর্ণনা মতে, ‘আমরা অনেক ভ্রমণ করেছি, পাহাড়ে গিয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা একসঙ্গে মাছ ধরেছি এবং বাইরে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমরা থিয়েটার, কনসার্ট এবং প্রদর্শনীতে গিয়েছি। জীবনটা ছিল পরিপূর্ণ।'
তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নেন এবং পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে একটি বড় গির্জায় বিয়ের অনুষ্ঠান করার স্বপ্ন দেখেন। এই লক্ষ্যে তারা বিয়ের আংটিও পছন্দ করেন। ভ্যালেরিয়া তার চাকরি ছেড়ে দেন এবং তার সৃজনশীল দিকটি লালন করতে শুরু করেন। এমনকি মারিওপোলে রাশিয়ার সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধের আগের বছরগুলো নিয়ে কবিতা লেখেন এবং তা প্রকাশও করেন।
৩৩ বছরের এই ইউক্রেনীয় ললনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘পুরোদমে আক্রমণের আগে বেশ কয়েক বছর আমি সত্যিই খুব খুশি ছিলাম, সুখি ছিলাম।’
কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল!
ভ্যালেরিয়া বলেন, ‘আমরা পুতিনের হুমকি সম্পর্কে জানতাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম যে, সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিন্তু আমি এটা নিয়ে ভাবতে চাইনি।’
২৪ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে, যেদিন পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরু হয়, অ্যান্ড্রি ভ্যালেরিয়াকে শহর ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ভ্যালেরিয়া তার অনুরোধ শোনেননি। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম যাই ঘটুক না কেন, আমাকে মারিওপোলে থাকতে হবে। আমাকে আমার শহর রক্ষা করতে হবে।’
এর কয়েক সপ্তাহ পরে তাদের দুজনেরই দেখা হয় আজভস্টালের সেই বাঙ্কারে। সেখানে তারা কেবল মাঝে মাঝে একে অপরের দেখা পেতেন। তখন সেগুলো ছিল কেবলই দুজনের ‘শুদ্ধ সুখের’ মুহূর্ত।
সেই মুহূর্তে, মারিওপোল ছিল একটি মানবিক বিপর্যয়ের কাছাকাছি। অবকাঠামোগুলোতে হামলার কারণে শহরের কিছু অংশে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। বেসামরিক বাড়িঘর এবং ভবনগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
এর মধ্যে ১৫ এপ্রিল ওই প্ল্যান্টে একটি বড় বোমা আঘাত হানে। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান ভ্যালেরিয়া। তিনি বলেন, ‘অসংখ্য মৃতদেহের মধ্যে একমাত্র জীবিত হিসেবে আমাকে পাওয়া যায়। এটি যেমন একটি অলৌকিক ঘটনা, তেমনি একটি ভয়ানক ট্র্যাজেডিও।’
প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে তাকে প্ল্যান্টের একটি ভূগর্ভস্থ হাসপাতালে আট দিন কাটাতে হয়। যেখানে রক্ত ও পচনের গন্ধ ছিল সর্বত্র। তার ভাষায়, এটি খুব ভীতিকর জায়গা ছিল, যেখানে আমাদের আহতরা বিচ্ছিন্ন অঙ্গসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। খুব কম চিকিৎসা সামগ্রী থাকায় তারা যথাযথ সাহায্য পায়নি।
এদিকে ওই ঘটনাইয় অ্যান্ড্রি ভ্যালেরিয়ার জন্য গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং সেখানেই বাঙ্কারে একটি বিয়ের পরিকল্পনা শুরু করেন।
ভ্যালেরিয়ার ভাষায়, ‘মনে হচ্ছিল যে, সে তাড়াহুড়ো করছে, আমাদের কাছে যেন আর সময় নেই। অ্যান্ড্রি নিজ হাতে টিনের ফয়েল থেকে কয়েকটি বিয়ের আংটি সদৃশ তৈরি করে এবং আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি কি না- জিজ্ঞাসা করে। আমি- অবশ্যই, হ্যাঁ বলেছিলাম। সে-ই ছিল আমার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম। আর টিনের ফয়েল দিয়ে তৈরি আমাদের আংটি- সেগুলো ছিল নিখুঁত।’
৫ মে ওই বাঙ্কারেই তাদের বিয়ে হয়। একজন কমান্ডার তাদের বিয়ে সম্পন্ন করেন। তারা ওই বাঙ্কারেই সেই বিয়ের অনুষ্ঠান করেন। যেখানে বিয়ের পোশাক হিসেবে ছিল তাদের ইউনিফর্ম। অ্যান্ড্রি তার স্ত্রীকে এই বলে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা বাড়ি ফিরে গেলে আসল আংটি এবং বিয়ে ঐতিহ্যবাহী সাদা পোশাক পরে তারা সঠিকভাবেই বিয়ে উদযাপন করবেন।
কিন্তু দুই দিন পর অর্থাৎ ৭ মে ওই ইস্পাত কারখানায় রাশিয়ান গোলাবর্ষণে অ্যান্ড্রি নিহত হন। যদিও ভ্যালেরিয়া বিষয়টি সরাসরি জানতে পারেননি। তিনি বলেন, অনেকে প্রায়ই বলে যে, কারো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তিনি ভেতরে ভেতরে কস্টকর কিছু অনুভব করেন। কিন্তু বিপরীতে আমার মেজাজটা অনেক ভালো ছিল। কারণ আমি ছিলাম সদ্য বিবাহিত এবং আমি প্রেমে পড়েছিলাম।
ভ্যালেরিয়া বলেন, আমি একজন নববধূ ছিলাম, স্ত্রী ছিলাম, কিন্তু এখন আমি বিধবা। এটা একটা ভয়ঙ্কর শব্দ। আমি সেই মুহূর্তে যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারিনি। আমার সহকর্মীরা সবসময় আমার কাছাকাছি ছিল। তারা আমার পাশে বসেছিল, তারা আমার পাশে শুয়েছিল, তারা আমাকে খাবার দিয়েছিল এবং আমাকে সমর্থন করেছিল। তবে আমি তখনই কাঁদতে পারতাম, যখন তারা দেখতে পেত না।
আজভস্টালে অবস্থান নেওয়া ইউক্রেনীয় সৈন্যরা অবশেষে ২০ মে আত্মসমর্পণ করে। মারিওপোল থেকে যুদ্ধবন্দি হওয়া ৯০০ জনের মধ্যে ভ্যালেরিয়াও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার শহর, বন্ধুবান্ধব এবং আমার স্বামী- তারা আমার পছন্দের সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে।’
ভ্যালেরিয়া দীর্ঘ ১১ মাস রুশ বন্দিশালায় ছিলেন। সেখানে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও অপব্যবহারের কথাও বলেছেন। গত বছরের এপ্রিলে, তিনি বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে মুক্তি পান এবং ইউক্রেনে ফিরে আসেন।
মারিওপোলে রাশিয়ান গোলাগুলির ফলে কতজন নিহত হয়েছে- তা বলা কঠিন। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে সংখ্যাটা ২০ হাজারের বেশি। আর জাতিসংঘের মতে, ৯০ শতাংশ আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মৃতদেহগুলো এখনও ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে।
ভ্যালেরিয়া যতদূর জানেন, তার স্বামীর মৃতদেহও এখন দখলকৃত শহরটির আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্টে রয়েছে। কখনও কখনও তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে তার (অ্যান্ড্রি) সঙ্গে কথা বলেন। ভ্যালেরিয়া বলেন, অ্যান্ড্রি প্রায়শই আমার স্বপ্নে দেখা দেয়।
(বিবিসি অবলম্বনে)