রাজধানী দখলের পরিকল্পনায় আরাকান আর্মি
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫৯ পিএম
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মধ্যেই জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) রাজ্যের আরেকটি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। মঙ্গলবারের এ বিজয়ের পর আরাকান আর্মি এখন রাখাইনের রাজধানী দখলের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে আরাকান আর্মির কাছে একের পর এক ঘাঁটি বা শহর হাতছাড়া হওয়ায় দেশটির সামরিক জান্তা শিবিরেও প্রচণ্ড অস্থিরতা বিরাজ করছে। জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক-অনিশ্চয়তা। সংঘর্ষ চলছে রাখাইনের সর্বত্র।
আতঙ্কিত হাজারো রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে রাজ্য ছেড়ে পালাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তারা সাগরপথে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। থাইল্যান্ড থেকে পরিচালিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম দ্য ইরাবতির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
এএ বলেছে, ঐতিহাসিক ম্রাউক-ইউ টাউনশিপে বেশ কয়েক দিনের লড়াইয়ের পর লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (এলআইবি) ৫৪০ কে তারা পরাজিত করেছে। সেখানে তারা এলআইবি ৩৭৭ এবং ৭৭৮ ব্যাটালিয়নের অন্তর্গত ঘাঁটিগুলোও ঘেরাও করে রেখেছে।
এলআইবির ব্যাটালিয়নগুলো রাখাইনের সাবেক রাজধানীর ম্রাউক-উ প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর, ঐতিহাসিক মঠ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় গোলাবর্ষণ করেছে। এএ দাবি করেছে, মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে তারা এলআইবি-৫৪০-এর সদর দপ্তরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এএ’র এখন লক্ষ্য হচ্ছে অবশিষ্ট দুটি সামরিক ঘাঁটি এবং অন্যান্য জান্তা ফাঁড়ি।
এএ হচ্ছে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য। এ অ্যালায়েন্সে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিও (টিএনএলএ) রয়েছে।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর অপারেশন-১০২৭ শুরুর পর থেকে এই জাতিগত জোট উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকের সঙ্গে চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার পর এ জোট জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের আক্রমণ বন্ধ করেছিল।
তবে অপারেশন-১০২৭-এর অংশ হিসাবে এএ ১৩ নভেম্বর থেকে প্রতিবেশী চিন রাজ্যের উত্তর রাখাইন ও পালেতওয়া জুড়ে বড় আকারের আক্রমণ পরিচালনা করছে। এই অ্যালায়েন্স পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সঙ্গেও জোট করে কাচিন রাজ্য ও সাগাইং অঞ্চলে জান্তার সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করছে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, বুধবার রাখাইনের উপকূলীয় রামরিতে জান্তা সৈন্য বৃদ্ধি করলে সেখানেও সংঘর্ষ হয়। স্থলযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর রামরিতে আরও সৈন্য পাঠায় মিয়ানমার জান্তা। বুধবার যুদ্ধবিমান ও গানবোট থেকে রামরিতে তারা গুলি চালায়। এএ সৈন্যরা জান্তার অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করেছে। শহরজুড়ে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জান্তা সৈন্যদের মৃতদেহও খুঁজে পেয়েছে।
বুধবার সকালে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়ের কাছাকাছি উপকূলেও জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ হয়। অং জায়া এবং অং মায়া কোন গ্রামের মধ্যে অবস্থিত, সেই যুদ্ধস্থল থেকেও পিছু হটেছে জান্তা সৈন্যরা।
একই দিন সকালে জান্তা সৈন্যরা জাহাজে পৌঁছে পান্নাগিউনের সার কোন বোকের পুরো গ্রামে আগুন দেয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলছে, সিত্তওয়েতে অবস্থিত সামরিক গানবোট এবং পুলিশ অ্যাটাক ব্যাটালিয়ন-১২ গ্রামটির আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০০ বার গোলাবর্ষণ করেছে। একই দিনে রাখাইনের মিনবিয়া, কিউকতাও এবং রাথেদাউং শহরেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
১৩ নভেম্বর রাখাইনে অপারেশন-১০২৭ আবারও শুরু করার পর থেকে এএ ১৬০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি দখল করেছে। এর মধ্যে সিত্তওয়ের কাছে পাউকতাও শহর এবং চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপও রয়েছে।
এদিকে রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাতের মধ্যে পড়ে প্রাণহানির পাশাপাশি বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। রাখাইনে থাকা বাকি রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশের শঙ্কা বাড়ছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়।
জাতিসংঘ বলছে, গত বছর সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা সাগরপথে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পালানোর চেষ্টা করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে গিয়ে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। ২০২৩ সালে সমুদ্রপথে পালাতে গিয়ে অন্তত ৫৬৯ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ২০১৪ সালের পর যা এক বছরে সর্বোচ্চ।
রোহিঙ্গাদের চলমান ঢলের মধ্যেই বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় নতুন করে ১৩০ জনের বেশি রোহিঙ্গা পৌঁছেছে। এ খবর নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। মিয়ানমার থেকে সেখানে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, গেল চার মাসে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে এমন অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়তে থাকায় রোহিঙ্গা সংকট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র বাবর বেলুচ বলেছেন, কোনো আশার আলো নেই। এ পর্যায়ে মিয়ানমারে শরণার্থীদের ফেরারও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।