জান্তার ভয়ে গুহায় বাস
বিদ্রোহীদের দখলে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শহর
শাবনুর নাহার
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২২ পিএম
হঠাৎ বিকট শব্দ (বোমা বিস্ফোরণ)। পরক্ষণেই গোলাগুলি। কখনো এক বা দুই ঘণ্টা, কখনো সারা দিন। বেলা-অবেলা বা দিন-রাত বলে কিছু নেই- মিয়ানমারের বিদ্রোহী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এখন সারা বেলায় যুদ্ধাবস্থা। থমথমে পরিবেশ। শুধু শান রাজ্যের শহরগুলো নয়- সব রাজ্যেই একই অবস্থা। জান্তা উৎখাত ‘তপস্যা’র ‘পূজা-অর্চনা’ এখন মিয়ানমারের পাহাড়ি শহরগুলোর অলিতে-গলিতে। যেখানে সেখানে রক্তের দাগ। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে ইটের দেওয়ালগুলো।
ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। এককথায় মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন এবং সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষে অসহায় হয়ে পড়েছে দেশটির নাগরিক জীবন। দুপক্ষের লড়াইয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। ক্ষমতা ধরে রাখার নেশায় নিরীহ মানুষের ওপর সমানতালে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। নিরুপায় হয়ে পরিবার-পরিজনসহ লোটাকম্বল গুছিয়ে গভীর জঙ্গলে ছুটছে স্থানীয়রা। অনেকেই আবার পাহাড় খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরি করছে ‘গুহাবাড়ি’। জান্তার ভয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে বাস করছে সেখানে! দ্য ইরাবতি, এএফপি, গার্ডিয়ান, আলজাজিরা।
গ্রামীণ মিয়ানমারের বেশিরভাগ মানুষেরই এখন এই দশা। প্রাণ বাঁচাতে ফিরে গেছেন আদিম জীবনে! শুরুটা ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই। দেশটির নির্বাচিত সরকারকে সেদিন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করে সামরিক সরকার। রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া চলমান অরাজকতার গোড়াপত্তনটাও সেদিনই। আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে সামরিক বাহিনী ও জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সংঘর্ষ।
পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসে চলতি বছরের গোড়ার দিকে। অক্টোবরে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করে জোর অপারেশন শুরু করে তিন জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠী- তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), ও আরাকান আর্মি (এএ)। নতুন নামে জান্তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘অপারেশন-১০২৭’। কারারুদ্ধ সু চিপন্থি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসও (পিডিএফ) তাদের সঙ্গে একজোটে লড়াই করছে। ফলে সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই আত্মসমর্পণ করছে শত শত সেনা।
ইতোমধ্যেই দেশটির প্রায় অর্ধেক বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। শুক্রবার গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, গত শনিবার উত্তরের শান রাজ্যের পাহাড়ের নামসান শহর দখল করে নিয়েছে টিএনএলএ। এটি এ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের দখলের সর্বশেষ শহর। টিএনএলএ বলেছে, ‘তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সামরিক স্বৈরশাসনকে পতন করা। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করা।’
তবে এখনো শঙ্কায় আছে নামসান শহরের বাসিন্দারা। কারণ, সেনা বাহিনীর হামলা থেমে নেই। নামসানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড লড়াই। হামলা তীব্র হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই অনেক মানুষ পালিয়ে গেছেন। আশ্রয় নিয়েছেন অস্থায়ী গুহায়। যারা যেতে পারেননি তারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওহমার (৫০) বলেছেন, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। লুকানোর জন্য গুহা আছে কিন্তু সেগুলো আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তবে ওহমার আশ্রয়ের জন্য নিজেই একটি গুহা খনন করেছেন। যেখানে ২০ জন মানুষ থাকতে পারবে। যারা পারছেন তারা লাল মাটির গুহাগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
গুহায় ঘর মিয়ানমারের বেসামরিকদের কাছে নতুন কিছু নয়। এর আগে (মার্চ মাসে) কারেন অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র মুত্রাউ জেলায় সামরিক বাহিনী তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছিল। তখনো ঠিক এভাবেই পাহাড় খুঁড়ে গুহা বানিয়েছিল স্থানীয় বাস্তুচ্যুতরা। গত দুই বছরে মুত্রাউয়ের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। বিমান থেকে চোখে পড়ে না এমন জায়গাগুলোতে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা গুহার ভেতরেই কাটছে তাদের আদিম জীবন। শুধু গুহাই নয়- গভীর জঙ্গলেও আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্যা মানুষ। গড়ে তুলেছে অস্থায়ী আবাসন। স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়েছে সেখানেই।
বাস্তুচ্যুত হওয়া দুই শতাধিক পুরুষ ও নারী বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য একটি মানবিক মিশন তৈরি করতে সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দুই মাসেরও বেশি সময় জঙ্গলে থাকার পর অনেক পরিবার আবার নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জান্তার ভয়াবহ হামলা থেকে বাঁচতে কায়াহ রাজ্যেও বেশ কিছু গুহা খনন করেছিল বাস্তুচ্যুত নাগরিকরা।