দামি বিমানবন্দর পেলেও ঋণে ডুবেছে নেপাল
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২২ পিএম
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে পোখারায় একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের কথা ভাবছিল নেপাল। কিন্তু অর্থের অভাব, রাজনৈতিক ডামাডোলসহ নানা কারণে সেই বিমানবন্দর তারা বানাতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত চীনের অর্থায়নে তারা সেই বিমানবন্দর নির্মাণ করে।
গত জুনে নেপালের নতুন পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম কোনো ফ্লাইট অবতরণ করে। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখারায় এই বিমানবন্দরটি নির্মাণ হয় চীনা অর্থে। উদ্বোধনের ছয় মাস পর প্রথম এর রানওয়েতে কোনো বিমান অবতরণ করে। সেটি এসেছে আবার সেই চীন থেকেই।
সিচুয়ান এয়ারলাইন্সের একটি এয়ারবাস এ৩১৯ বিমান ছিল সেটি। বিমানে থাকা যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাতে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল বিমানবন্দরে।
চীনা কোম্পানির হাতে এবং চীনের অর্থায়নেই এই ব্যয়বহুল বিমানবন্দর তৈরি করেছে নেপাল। এর মাধ্যমে চীন বড় চুক্তি পেলেও নেপাল বিশাল ঋণে পড়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস।
‘চীন পেল বিশাল কাজ, নেপাল পেল ঋণ ও দামি এক বিমানবন্দর শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানবন্দর নির্মাণে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে; এমনকি ভূপ্রাকৃতিক যেসব পরীক্ষা করা জরুরি ছিল, সেগুলোও করা হয়নি। সেই সঙ্গে এই বিমানবন্দর থেকে তেমন একটা আয়ও করতে পারছে না নেপাল।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমের দাবি, চীন ঋণগ্রহীতা দেশগুলোকে ঋণের মধ্যে ডুবিয়ে রাখছে। পোখারা বিমানবন্দরের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে সেই একই মডেল। যাতে প্রায়শই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রজেক্টগুলো থেকে চীনা সংস্থাগুলো বিপুল অর্থ পেয়ে থাকে।
নিউইয়র্ক টামইস জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্যকে টেক্কা দিতে চীন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে নেপালের বিমানবন্দরও তার একটি। নেপালের দক্ষিণেই রয়েছে ভারত, যেটি চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্যতম। বিমানবন্দর নির্মাণের পর বেইজিং জানায় যে, এই বিমানবন্দরটি তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ অংশ।
এই প্রকল্পের শুরু করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শি জিনপিং। বিশ্বজুড়ে এই প্রকল্পের অধীনে আনুমানিক এক ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান প্রদান করেছে চীন।
নেপাল যদিও অস্বীকার করেছে যে, এই বিমানবন্দর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ। তারপরেও এই বিমানবন্দরটি নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়।
পোখারার এই বিমানবন্দর বানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিনেমাকের প্রকৌশল সংস্থা চায়না সিএএমসি। তারা ভবনের সব উপাদান ও মাটি সরানোর যন্ত্রপাতি চীন থেকে এনেছিল। বিমানবন্দরের ডিজাইনও চীনের ডিজাইন, সেখানে যত ধরনের নিরাপত্তা ও শিল্পপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তার সবই চীনের। নেপালে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত চেন সং বলেছেন, এই বিমানবন্দর চীনের প্রকৌশল মানের মুক্ত প্রকাশ।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি তদন্তের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছে, এই প্রকল্প থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করেছে চীনা কোম্পানিটি। এই প্রকল্পের কারণে নেপাল একটি অপ্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পেয়েছে।
চীনা কোম্পানি সিএএমসি ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বিড করে এই বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ জিতে নেয়। ২০১৭ সাল থেকে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
যদিও পরে কোম্পানিটি খরচ ৩০ শতাংশ কমিয়ে ২১৬ মিলিয়ন ডলারে বিমানবন্দরটি নির্মাণ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এটি নির্মাণে চীন ও নেপাল ২০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করে। চীন বিমানবন্দর নির্মাণের অর্থ দেবে নেপালকে। এই অর্থের এক চতুর্থাংশ হবে আবার সুদমুক্ত ঋণ।
নেপাল বাকি অর্থ চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক থেকে ধার করে। এর সুদ ধরা হয় ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করবে নেপাল।
নিউইয়র্ক টাইমস তাদের নিজস্ব তদন্ত ও বিমানবন্দরে নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার আর শত শত পৃষ্ঠা সরকারি নথি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, চীনের সিএএমসি এই বিমানবন্দর নির্মাণকাজের শর্ত নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে, এমনকি নেপাল সরকারের তত্ত্বাবধানকেও তারা পাত্তা দেয়নি।
এ পরিস্থিতিতে নেপাল এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে বিপদে পড়েছে। একদিকে এ বিমানবন্দর নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে, আরেক দিকে বিমানবন্দরের এত পরিমাণে যাত্রী আসছে না যে তার পক্ষে চীনের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব।