কুখ্যাত থায়ারওয়াদ্দি কারাগারের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে মিয়ানমার
শাবনুর নাহার
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৪৯ পিএম
থায়ারওয়াদ্দি কারাগার। রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য এক নরকের নাম। যার নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে মিয়ানমার। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শোষণের শেষ নিদর্শন এ ‘জল্লাদখানাটি’ বাগো প্রদেশের উত্তরে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
নিত্যনতুন নির্যাতনে কুখ্যাত কারাগারটি মিয়ানমার শাসকদের প্রায় এক শতাব্দীর নিপীড়নের প্রতীক। যেখানে পা রাখলেই রক্তাক্ত হতে হয় বন্দিদের। মাত্রাতিরিক্ত জুলুমে মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে অনেক বেশি। বর্বর অত্যাচারের শিকার হন নারীরাও।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী সু চি নেতৃত্বাধীনের এনএলডি সরকারের পতনের পর থেকে কয়েদি আরও বেড়েছে। কপালজোরে কেউ ছাড়া পেয়েছেন কয়েক মাস পরই। কেউ ভুগছেন মাসের পর মাস।
সম্প্রতি দেশটির স্থানীয় গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে সদ্য মুক্তি পাওয়া সেসব এনএলডির সাবেক রাজনৈতিক বন্দিদের জীবনদশা উঠে এসেছে। অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য সান তুনসহ অনেককেই বন্দি করা হয় ইয়াঙ্গুনের ইনসেইন কারাগারে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় কাটানোর পর হঠাৎই আসে তাদের কারা বদলির খবর। ১৫০ জন রাজনৈতিক বন্দিকে স্থানান্তর করা হয় এই কারাগারে। পায়ে শিকল বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শোচনীয় হয়ে ওঠে তাদের অস্তিত্ব। প্রায় ৪০ জন কারা কর্মকর্তা, যাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি ছিল। মাথা নিচু করে যেতে বলা হয় বন্দিদের। যেতে যেতে লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করা হয়। এ অগ্নিপরীক্ষার পর কারাগারের প্রধান কার্যালয়ের দিকে শিকল বাঁধা পায়ে ২০০ মিটার দৌড়াতে বলা হয়। পুরো সময় মাথা নিচু করে সব মেনে নিতে হয়েছে বলে জানান সান তুন। প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর প্রখর সূর্যের নিচে ধুলামাটিতে বসতে বাধ্য করা হয়। সঠিকভাবে বসতে ব্যর্থ হলে আবারও নিষ্ঠুরভাবে মারধর করা হয়।
এক ঘণ্টা পর দুটি কুকুর নিয়ে সেখানে হাজির হন সাদা চামড়ার এক লোক। মুখে সিগারেট নিয়ে দাঁড়াতেই সবাই চুপ। নাম ইয়ে ইয়েন্ট নায়িং। মিয়ানমারের কারা বিভাগের সাবেক পরিচালক। বর্তমানে থায়ারওয়াদ্দি কারাগারে প্রধান কর্মচারী হিসাবে কাজ করছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের আগে প্রেসের সদস্যদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর জান্তা শাসন ব্যবস্থার নিপীড়নের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। বন্দিদের সঙ্গে তার নৃশংস আচরণ দিন দিন বাড়ছে।
রাজনৈতিক বন্দিদের উদ্দেশে নায়িং বলেন, ‘এটা থায়ারওয়াদ্দি কারাগার। তোদের জন্য জাহান্নাম। এখানে তোরা শক্তিহীন।’ আরও বলেন, ‘কারাগারের নিরাপত্তা প্রটোকল লঙ্ঘন করলে তোদের এখানেই শেষ করে দেওয়া হবে। সান তুন আরও জানান, ইয়েন্ট নায়িং খুব অদ্ভুতভাবে হাঁটেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি একটি পা হারান। এটি কীভাবে হয়েছিল সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়। হাঁটার জন্য একটি কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্য নেন নায়িং। আরেকজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দি দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, নায়িং ‘থায়ারওয়াদ্দি কারাগার বন্দিদের জন্য নরক’ বাক্যটি বারবার পুনরাবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন।
জল্লাদখানা থেকে ফিরে আসা কয়েদিদের ভাষায়, থায়ারওয়াদ্দির বন্দিরা নিয়মিতভাবে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। প্রথম সপ্তাহগুলোতে তাদের নির্জন কারাগারে কাটাতে হতো। তাদের পায়ে বেঁধে দেওয়া হতো লম্বা লোহার রড। মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টার বিরতি দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে কাজ করানো হতো। শুধু পুরুষ নয়, রেহাই পাননি নারীরাও। ব্ল্যাক রোজ নামের একজন নারী গ্রেফতারের আগে ইয়াঙ্গুনে প্রতিবাদী নেতা ছিলেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘থায়ারওয়াদ্দি কারাগার আমার জন্য অভিশপ্ত জায়গা।’ বলেন, ‘মান্দালয় কারাগার থেকে স্থানান্তরিত ১৬ জন মেয়েকে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছিল যতক্ষণ না তাদের পিঠ দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল। নায়িংকে সব থেকে বর্বর বলে চিহ্নিত করেছেন রোজ। আরও বলেন, শুধু বন্দিদের সঙ্গে নয়, কারাকর্মীদের সঙ্গেও বাজে আচরণ করতেন নায়িং।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দি জানান, বন্দিদশায় তার পায়ে লোহার রড বেঁধে কারাগারের চারপাশে পাঁচবার দৌড়াতে বাধ্য করা হয়। তিনি যখন দৌড়াচ্ছিলেন তখন সাইকেলে থাকা এক কর্মী তাকে গরু-মহিষ তাড়ানোর মতো বেত্রাঘাত করেন। তার পা যখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তখন বলেছিলেন আর মারবেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আবারও অমানুষের মতো তাকে মারতেই থাকে। নির্যাতন করে বন্দিদের মেরে ফেলারও খবর পাওয়া গেছে। লোহার বেড়িতে পা বাঁধা অবস্থায়ই দলবেঁধে জেলসীমার ভেতরের পাথুরে পাহাড় ভাঙতে হয়। পেছনে রাখালের মতো লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশ।
নির্বাসিত অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের মতে, শাসনের বিরোধিতা করার জন্য গত আড়াই বছরে ২৪ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে। তার কয়েক মাস পর থেকেই কারাগারটি বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্য আটককেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে এটি মিয়ানমারের সবচেয়ে ঘৃণ্য কারাগারগুলোর একটি হিসাবে পরিচিতি পায়। এই লজ্জাজনক ইতিহাসকে এখন আরও কলঙ্কিত করছে দেশটির জান্তা সরকার। আবারও এ কারাগারকে ধারাবাহিক শাসনের বর্বরতার স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।