Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ওয়াশিংটন-মস্কোর সেই হটলাইন কি এখনো চালু আছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩৬ পিএম

ওয়াশিংটন-মস্কোর সেই হটলাইন কি এখনো চালু আছে

বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সংকটকালে নিজেদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য ৬০ বছর আগে একটি হটলাইন চালু করেছিল। 

সেই লাইন ব্যবহার করে ১৯৬৩ সালের ৩০ আগস্ট ওয়াশিংটন মস্কোকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল। প্রথম পরীক্ষামূলক বাক্যটি ছিল এ রকম—‘দ্য কুইক ব্রাউন ফক্স জাম্পড ওভার দ্য লেজি ডগ 1234567890 এর বাংলা হল-ক্ষিপ্র বাদামি শিয়াল অলস কুকুরের ওপর লাফিয়ে পড়ল ১২৩৪৫৬৭৮৯০।’ 

যদিও এই বার্তার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তবে বাক্যটিতে ইংরেজি সব অক্ষর ও নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে দুই পক্ষ কি হটলাইনে যোগাযোগ করে, নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে—সে ব্যাপারে বেশি কিছু জানা যায় না।

১৯৬২ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব মাত্র ১৮০ কিলোমিটার। এতে যুক্তরাষ্ট্র হুমকি অনুভব করে। এরপর একটি মার্কিন উড়োজাহাজ ভূপাতিত করা হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করেছিলেন। 

তবে শেষ মুহূর্তে সোভিয়েত নেতা রেডিও মস্কোতে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, কিউবা থেকে পারমাণবিক অস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। এই ঘোষণায় পুরো বিশ্বে স্বস্তি ফিরেছিল।

এই ঘটনার পর দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস তৈরির অংশ হিসেবে সরাসরি যোগাযোগের কথা ভাবতে শুরু করে। পরে ১৯৬৩ সালের ৩০ আগস্ট একটি হটলাইন চালু হয়।

‘লাল টেলিফোন’ নামে এই হটলাইন পরিচিতি পেলেও এটি আসলে টেলিফোন ছিল না। এটি ছিল একটি টেলেক্স মেশিন, যেটায় বার্তা পাঠানো যেত। আটলান্টিক ও ইউরোপের নিচ দিয়ে গিয়েছিল এই হটলাইনের তার। দুই পক্ষই প্রতি ঘণ্টায় এটি পরীক্ষা করত।

রাশিয়ার ভাষাবিদ হাওয়ার্ড প্যাট্রিক ২০১৪ সালে মিনেসোটায় পাইওনিয়ার প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রথম এই যন্ত্রটি পরিচালনা করতে তিনি সাহায্য করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই লাইনটি দেখভাল করত পেন্টাগন। তারা প্রায়ই বেসবলের স্কোরকে বার্তা হিসেবে পাঠাত, যার আসলে কোনো অর্থ ছিল না। 

অন্যদিকে ক্রেমলিন রাশিয়ার ক্ল্যাসিক সাহিত্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি পাঠাত।

এই ভাষাবিদ বলেন, হটলাইনটি ব্যবহার করে সত্যিকার যে বার্তা এসেছিল, তা ছিল প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়েছিল, কেনেডি ডালাসে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের ভুল-বোঝাবুঝি এড়ানো: ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধ এড়াতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল এই হটলাইন। ১৯৭৩ সালে ইওম কিপুর যুদ্ধের সময় নেতারা হটলাইনে যোগাযোগ করেছিলেন।

সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের কাছে ভোরবেলা একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। লিন্ডন সেই বার্তা পেয়ে জেগে উঠেছিলেন। বার্তার বিষয়বস্তু তাকে বিস্তারিত জানানোর পর তিনি আবার ঘুমাতে চলে যান। বার্তায় ইসরায়েল তার আরব প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে জানানো হয়।

এই যুদ্ধের সময় দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১৯টি বার্তা আদান-প্রদান হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তারা।

হটলাইনটি ব্যবহার করে সত্যিকার যে বার্তা এসেছিল, তা ছিল প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়েছিল, কেনেডি ডালাসে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১৯টি বার্তা আদান-প্রদান হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তারা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আদান-প্রদান হয়, যখন ইসরায়েল মার্কিন নজরদারি জাহাজ ইউএসএস লিবার্টিতে হামলা চালায়। এতে জাহাজের ৩০ আরোহী নিহত হয়েছিলেন। এটিকে পরে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ঘটনার পর মার্কিন বাহিনী ছুটে যায়। তখন জনসন রুশ প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনকে আশ্বস্ত করে বলেন, ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু রাশিয়া নয়।

জবাবে কোসিগিন ফিরতি বার্তা পাঠিয়ে সংঘাত ‘অবিলম্বে বন্ধ’ করার আহ্বান জানান ও ইসরায়েলের ওপর জনসনকে চাপ তৈরি করতে বলেন।

প্রেসিডেন্ট জনসন মস্কোর সঙ্গে হটলাইনে যোগাযোগ পছন্দ করতেন। ওয়াশিংটনে এটি মোলিংক নামে পরিচিত। জনসন এর মাধ্যমে অ্যাপোলো মহাকাশ মিশন সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য পাঠাতেন।

নিক্সনের হস্তক্ষেপ: এই হটলাইন আরেকটি ইসরায়েল-আরব যুদ্ধের সময় বেশ কাজে এসেছে। তবে একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ১৯৭৩ সালে।

ইহুদিদের পবিত্র দিন ইওম কিপুরের সময় ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে মিসর ও সিরিয়া অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল। তবে দ্রুতই সোভিয়েতের সেই দুই মিত্রের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল ইসরায়েল।

সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনেভ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে ওই অঞ্চলে উভয় পরাশক্তির পক্ষ থেকে বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দেন। তবে এটিকে মার্কিন কর্মকর্তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন এবং তারপর মস্কো নিজে থেকে সেনা পাঠানোর কথা ভাবছে বলে হটলাইনে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু নিক্সন এতে কোনো সাড়া দেননি।

নিক্সনের সহযোগীরা মনে করেন, ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির তদন্ত বন্ধ করতে তথাকথিত সেটারডে নাইন ম্যাসাকার এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো অ্যাগনিউ দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করলে বেশ চাপে ছিলেন নিক্সন। এতে ওই দিন বেশ মদ্যপ ছিলেন তিনি। পরে জানা গেছে, ওই দুর্নীতির সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্টের কোনো যোগসূত্র ছিল না।

হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে নিক্সনের সহযোগীরা মার্কিন বাহিনীর প্রস্তুতি বাড়ানোর দায়িত্ব নেন। কিসিঞ্জার তখন ঠান্ডা মাথায় ব্রেজনেভের কাছে বার্তা পাঠান।

যেভাবে সতর্ক করা হতো: এই হটলাইন শুধু উত্তেজনা এড়ানোর জন্যই ব্যবহার করা হয়নি, কখনো কখনো এটি সতর্কতা জারি করতেও ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯৭৯ সালে জিমি কার্টার ব্রেজনেভকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে বার্তা পাঠান। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামি গেরিলাদের অর্থায়ন শুরু করে।

এরপরের বছরই জিমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আবার সতর্ক করে জানান, সোভিয়েত যদি সংস্কারবাদী সলিডারিটি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দমন করতে পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তবে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। মস্কো অবশ্য শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেনি।

২০০৮ সালে হটলাইনের পরিবর্তে একটি নিরাপদ ই-মেইল লিংক তৈরি করা হয়। তবে এটি আনুষ্ঠানিক বার্তা আদান-প্রদানে ব্যবহার করা হয়। মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে বারাক ওবামা এই মেইল অপসারণ করেন।

গত বছর ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। কখনো কখনো সরাসরি রাশিয়াকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন এই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে পরিণতি ভালো হবে না বলে বার্তা দিয়েছে। আবার কখনো কখনো ব্যক্তি মাধ্যমে সতর্ক করেছে, যেমন সিআইএ পরিচালক বিল বার্নস দুই দেশের মধ্যে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত বছর বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি রুশ সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ে’ কথা বলার ক্ষমতা আছে।

বার্লিন সেন্টার ফর কোল্ড ওয়ার স্টাডিজের সাবেক প্রধান গ্রাইনার বলেন, ‘বিশ্বকে আশ্বস্ত করার জন্য দুই দেশের হটলাইন এক ধরনের বাহ্যিক সংকেত ছিল, তারা দ্বিপক্ষীয় জরুরি যোগাযোগের মূল্য বুঝতে পেরেছিল এবং তারা ১৯৬২ সালের সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতি আর তৈরি হতে দিতে চায় না।’

তবে এই টেলেক্স মেশিনটি খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি৷ শুধু পরীক্ষা করার জন্য যন্ত্রটি কয়েকবার চালু করা হয়েছিল, তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে এটি ব্যবহৃত হয়নি বলে জানান গ্রাইনার। 

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধ এবং ১৯৭৩ সালে ইওম কিপুর যুদ্ধের সময় নেতারা টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলেন।

১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর পতন ও ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে হটলাইন থাকার বিষয়টি বাহুল্য হয়ে পড়েছিল।

এ ছাড়া প্রযুক্তির উন্নতির কারণে দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম চলে এসেছে। কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ হয়েছে।

কেউ একজন ভাবতে পারেন, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর হয়তো ‘লাল টেলিফোন’ বেজে উঠেছিল। গ্রাইনার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জানি না। এ ধরনের যোগাযোগের কথা সাধারণত প্রকাশ করা হয় না।’

গ্রাইনার বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা যায়। বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধে হটলাইন কোনো সহায়ক হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তার।

গ্রাইনার বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে, দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও কূটনীতিকদের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ ছিল, তা কার্যত ভেঙে গেছে। সেখানে এখন একধরনের নীরবতা বিরাজ করছে। এটিই স্নায়ুযুদ্ধের চরম পর্যায়ের পরিস্থিতি থেকে বর্তমানের পরিস্থিতিকে আলাদা করে দিয়েছে। কারণ, তখন অন্তত দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে হটলাইন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

তথ্যসূত্র: এএফপি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম