ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের পরিণতি সেই সব মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধিতার জন্য চরম মাশুল দিয়েছেন। আর কত দ্রুতই না মানুষ তার পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে।
রাশিয়ায় গত জুনে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তখন বিশ্বজুড়ে সমালোচকরা বিষয়টিকে রুশ নেতার দৃশ্যত যুদ্ধকালীন দুর্বলতা কিংবা বদান্যতা হিসেবে দেখছিলেন। এমনকি কেউ কেউ বলেছিলেন, সংক্ষিপ্ত এ অভ্যুত্থান পুতিন-পরবর্তী যুগের সূচনা করেছে।
দুই মাস পর নিজের ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন প্রিগোজিন। ২৩ আগস্ট মস্কো থেকে নিজের এলাকা সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়ে খোলা মাঠে আছড়ে পড়ে। পুতিন নিরাপদে ক্রেমলিনে আছেন। জনসমক্ষে তিনি প্রিগোজিনকে ‘মন্দ ভাগ্যের’ একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে প্রশংসা করেছেন!
দুই দশকের বেশি সময় ধরে যে ব্যক্তিদের রুশ নেতার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়েছে, তারা নিয়মিত নিজেদের নির্বাসিত, বন্দি কিংবা মৃত অবস্থায় পেয়েছেন। দ্রুত তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
প্রিগোজিনের সঙ্গে ওয়াগনার গ্রুপের বাকি শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কয়েকজন নিহত হন। অন্যরা তার মৃত্যুর পর ‘নীরব’ হয়ে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধারণা, বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়োজাহাজটি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের কয়েকজন বলেছেন, পুতিনই উড়োজাহাজটি ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন বলে তারা মনে করেন।
পুতিনের রাশিয়ায় এমন একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে নেতার অবমাননা কখনো ক্ষমা করা হয় না। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যে ব্যক্তিদের রুশ নেতার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়েছে, তাদের কেউ রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হয়েছেন, কেউ বন্দি হয়েছেন কিংবা তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দ্রুত তাদের প্রভাব খর্ব করে দেওয়া হয়েছে।
এ ধারার শুরুটা হয়েছিল রুশ নেতা পুতিনের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রথম দিকেই। তার উত্থানে ভূমিকা ছিল প্রভাবশালী বরিস বেরেজোভস্কির। পুতিনকে অপমান করায় তাকে পালাতে হয়েছিল। কয়েক বছর ধরে তাকে গণশত্রু হিসেবে দেখানো হয়েছে।
পরে ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যে তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পুতিনের আনুগত্য না করায় আরেক প্রভাবশালী মিখাইল খোদোরকোভস্কিকে এক দশকের বেশি সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থার একজন নেতা যখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন অবশ্যই সেটার একটি পরিণতি আছে।
এক সময়ের রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সের্গেই স্ক্রিপাল যুক্তরাজ্যের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন (ডাবল এজেন্ট)। ২০১৮ সালে নার্ভ এজেন্ট (বিষাক্ত গ্যাস) প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পরে তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘ঘৃণ্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন পুতিন।
রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কয়েক সদস্যকে সবচেয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে, যাদের বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করা হয়। পক্ষ ত্যাগ করা রুশ গুপ্তচর আলেকসান্দার লিতভিনেঙ্কো প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন, পুতিন একটি অপরাধ সিন্ডিকেটের মতো রাশিয়াকে চালাচ্ছেন। তাকে ২০০৬ সালে বিরল তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
পুতিনের জন্য রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে যারা আবির্ভূত হয়েছেন, তাদেরও ভুগতে হয়েছে। বিরোধী রাজনীতিক বরিস নেমতস্তভকে ২০১৫ সালে ক্রেমলিনের কাছে একটি সেতুর ওপর গুলি করে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রপন্থি রাজনীতিক অ্যালেক্সি নাভালনি কারাগারেই আছেন। স্ক্রিপালকে যে নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল, ২০২০ সালে নাভালনিকেও একই ধরনের গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
পুতিন ২৪ জুন প্রিগোজিনকে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য অভিযুক্ত করে যে মুহূর্তে বক্তব্য দেন, এর পর থেকেই তার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক ভুল করে এই শব্দ ব্যবহার করেননি। কেজিবিতে বলা হয়ে থাকে, বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমার অযোগ্য।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো আলেকসান্দার বাউনভ লিখেছেন- এ ধরনের শাসনব্যবস্থার একজন নেতা যখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন অবশ্যই সেটার একটি পরিণতি আছে। অন্যথায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক, ধারণাগত নীতি এবং অনুশীলনের ওপর গড়ে ওঠা একটি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
বাউনভ বলেন, প্রিগোজিনকে শাস্তি দেওয়ার স্পষ্ট কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়া এবং রাশিয়ায় তার অবাধে বিচরণকে পুতিনের শাসন ব্যবস্থার অসহায়ত্ব ও অস্বস্তিকর লক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল।
প্রিগোজিন বলেছিলেন, ওয়াগনার বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল মস্কোর সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাত, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নয়। এরপরও এ বিদ্রোহকে পুতিনের ২৩ বছরের শাসন আমলে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিল।
বিদ্রোহের সময় পুতিন বলেছিলেন, এটা হলো আমাদের দেশ ও জাতির পিঠে ছুরি মারার শামিল। অতি উচ্চাভিলাষ ও ব্যক্তিস্বার্থ বিশ্বাসঘাতকতার দিকে ঠেলে দেয়।
অবশ্য এ ভাষণ দেওয়ার সময় প্রিগোজিনের নাম উচ্চারণ করেননি পুতিন। সাধারণত কাউকে শত্রু মনে করলে তিনি তার নাম উল্লেখ করেন না। ভাষণে রুশ নেতা কঠিন শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন।
যখন কয়েক ঘণ্টা পর বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে ক্রেমলিন একটি সমঝোতার ঘোষণা দিয়েছিল, তখন পুতিনের পুরো প্রতিক্রিয়াটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সমঝোতা অনুযায়ী ওয়াগনারের ভাড়াটে যোদ্ধারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে রেহাই পাবেন এবং প্রিগোজিন বিচারের মুখোমুখি না হয়েই বেলারুশে চলে যাবেন বলে জানানো হয়।
প্রিগোজিনকে হত্যায় কেন কালক্ষেপণ
ক্রেমলিন সম্পর্কে ভালো জানাশোনা আছে, এমন কয়েক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, আফ্রিকা এবং সম্ভবত আবারো ইউক্রেনের ক্ষেত্রে প্রিগোজিনের ভূমিকা ক্রেমলিনের জন্য উপকারী বিবেচনায় তাকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুত দখলের মাধ্যমে রাশিয়াকে বিরল বিজয় এনে দিয়েছিল প্রিগোশিনের বাহিনী।
আবার অন্যরা বলছিলেন, ভাগনারের যোদ্ধাদের ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকা এবং বিদ্রোহের সময় তাৎক্ষণিক তাদের পরাজিত করাটা বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে কেউ কেউ বলেছিলেন, চূড়ান্ত পরিণতি এখন পর্যন্ত আসেনি।
উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার আগে ওই সপ্তাহেই একটি ভিডিও বক্তব্য প্রচার করেন প্রিগোজিন। এটি ছিল বিদ্রোহের পর প্রথমবারের মতো তার কোনো ভিডিও বার্তা। সামরিক পোশাক গায়ে তার দাবি অনুযায়ী, ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার কোনো এলাকায় ভিডিওটি ধারণ করা।
ভিডিওতে তিনি বলেন, রাশিয়াকে সব মহাদেশে সেরা অবস্থানে নিয়ে যেতে এবং আফ্রিকাকে আরও মুক্ত করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়াগনারের যোদ্ধারা।
প্রিগোজিন তার স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহে রাশিয়ার যে সামরিক নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন, তাদের সবাই বিশেষ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু, সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ স্বপদে বহাল আছেন। ইউক্রেনের পালটা আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়ায় নিয়মিতই সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করছেন পুতিন।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস।