হাজার হাজার ইহুদিকে বাঁচিয়েছিলেন যে মুসলমানরা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৩৫ পিএম
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আলবেনিয়া এমন একটি দেশ যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের তুলনায় সেসময় দেশটিতে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে যায়।
আলবেনীয় বেশিরভাগ পরিবারই মুসলমান। নাৎসি শাসনের নিপীড়নের শিকার হয়ে হাজার হাজার ইহুদি জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার মতো দেশ থেকে পালাতে শুরু করে। তখন আলবেনীয় পরিবারগুলো তাদের বাড়িতে ইহুদিদের আশ্রয় দেয়, পালিয়ে আসা শরণার্থীদের প্রাণ রক্ষা করে তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই, ১৯৩৮ সালে আলবেনিয়ার রাজা প্রথম জোগ ৩০০ জনেরও বেশি ইহুদিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন, যাদের এমনকি আলবেনীয় নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু নিজ ক্ষমতায় তাদেরকে রক্ষা করা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে ইতালি আলবেনিয়া আক্রমণ করে এবং দেশটিকে তারা নিজেদের রক্ষাকারী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। রাজা প্রথম জোগকে ইতালি পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে আলবেনিয়ায় ইহুদিদের প্রবেশ তখন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন আলবেনিয়ার ভূখণ্ডে তিন হাজারেরও বেশি ইহুদি শরণার্থীর বসবাস ছিল।
এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে জায়গা দেয়ার বিষয়টিকে আলবেনিয়ার নাগরিকদের ঐতিহ্যগত সংহতি এবং ‘বেসা’ নামক মর্যাদার রীতি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আলবেনিয়ান আমেরিকান সিভিক লীগের শার্লি ক্লয়েস ডিওগার্ডি বলেন, আলবেনীয়রা ইহুদিদের তাদের পরিবারে আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিল, তাদের যত্ন করেছিল, তাদের লুকিয়ে রেখেছিল। এবং যখনই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠত, তারা তাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করতো।
যারা শরণার্থীদের সাহায্য করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ যারা কোন ধরণের রাজনীতি বা সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা জিনিসই ছিল, মানবতা।
'হিস্ট্রি'স সিক্রেট হিরোজ' নামে এক পডকাস্টে হেলেনা বোনহ্যাম কার্টার বলছিলেন, আর্সলান রেজনিকি ছিলেন একজন খাদ্য ব্যবসায়ী। তিনি শত শত ইহুদি শরণার্থীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের এবং নিজের পরিবারের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন।
আর্সলানের পরিবার ছিল মুসলিম, যা আলবেনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম, দেশটিতে জনসংখ্যার মাত্র ১৭ শতাংশ খ্রিস্টান।
তিনি নিজেকে আলবেনিয়ান সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজের মানবিক বোধের জন্য গর্বিত, যার কারণে আজও তিনি ‘বেসা’ রীতি মেনে চলেন।
‘বেসা’ নামক সম্মানের রীতি বা আচরণবিধি বলতে এক ধরণের কঠোর নৈতিক নিয়ম পালনকে বোঝায়, যা অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং সহনশীলতার উপর ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
বেসা মানে ‘সম্মানের অঙ্গীকার’ এবং এর উৎস খুঁজে পেতে আপনাকে ১৫ শতকের বাচিক ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে, যা এখনো আলবেনীয়দের মধ্যে টিকে আছে।
‘বেসা মানে হল অন্যকে সম্মান দেয়া এবং সমান চোখে দেখা মানে নিজেকে সম্মান করা। এর প্রধান মূল্যবোধের জায়গাটি হল একজন অতিথিকে নিঃশর্ত সুরক্ষা দেয়া, এমনকি নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে হলেও তাকে রক্ষা করা’, বলেছেন ডিওগার্ডি৷
এই ঐতিহ্য শত বছর ধরে কানুন বা আইনের অংশ হিসেবে চলে আসছে। কানুন বলতে সাধারণত অলিখিত আইন, যা ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এক ধরণের আইনকে বোঝায়। যা উত্তর আলবেনিয়ার উপজাতিরা ১৫ শতকে তৈরি করেছিল।
আলবেনিয়ায় আগত বেশিরভাগ ইহুদি ছোট শহর এবং পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল, যেখানে আলবেনিয় সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ বাস করতো।
কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেখানে ইহুদিদের খুঁজে বের করার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল।
শরণার্থীরা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার এবং পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে থাকত। কিন্তু কখনও কখনও তাদের লুকানোরও প্রয়োজন ছিল না। বিষয়টি এমনই ছিল।
নাৎসিরা যখন আলবেনিয়া দখল করে, তারা দাবি করেছিল যে আলবেনিয়ার কর্তৃপক্ষ যেন তাদের দেশে থাকা ইহুদিদের তালিকা সরবরাহ করে, যেন ওই ইহুদিদের নির্বাসনে পাঠানো যায়। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা দিতে অস্বীকার করে।
আলবেনিয়ান আমেরিকান সিভিক লিগের সাথে কাজ করার সময়, শার্লি ডিওগার্ডি অনেক পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়ে থাকা ইহুদিদের অসংখ্য গল্প খুঁজে পান।
দেশটিতে ইহুদিদের কোন সাহায্য দেওয়া জাতীয় সম্মানের বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত।
আলবেনীয়দের মানবিক চরিত্রের স্বীকৃতি দিতে, হলোকস্টের শিকারদের জন্য ইসরাইলে ইয়াদ ভাশেম নামে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে।
সেখানে ইহুদি সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য যারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল এমন প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়, তবে নাৎসি শাসনের নিপীড়নই আলবেনিয়ার জন্য প্রথম বা শেষ চ্যালেঞ্জ ছিল না।
একটি নিয়ম, কোন ব্যতিক্রম নয়
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সময় এবং ভুক্তভোগী পরিবর্তন হলেও ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৯০-এর দশকে, পাঁচ লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু, যাদের বেশিরভাগই জাতিগত আলবেনীয়, তারা সার্ব সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আলবেনিয়ার উদ্দেশ্যে কসোভো ছেড়ে যায়।
নেভিলা মুকা, একজন আলবেনীয় নারীর নাতনি, তিনি একটি উদ্বাস্তু পরিবারকে উদ্ধার করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, সেসময় আলবেনিয়ান পরিবারগুলো কসোভার শরণার্থী শিবিরে যেতো, একটি পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদেরকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসতো।
তারা তাদের আত্মীয় বা বন্ধু না, তারা অপরিচিত, কিন্তু আলবেনীয়রা তাদের স্বাগত জানাত, তাদের খাওয়াত, পরাত। তাদের সাথে এমনভাবে আচরণ করত যেন তারা তাদেরই পরিবারেরই অংশ।
যখন নেভিলাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তার দাদী যে এমনটা করেছেন সেটা কেন করেছেন বলে মনে হয়?
তখন তিনি কাঁধ তুলে জবাব দেন, ‘এটা আলবেনিয়ান রীতি। এটা চুম্বনের মতো। চুম্বনের রীতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বর্তায়’।
সূত্র: বিবিসি বাংলা