১৮ শতকের পুলিশ রেকর্ডসে প্রকাশ পেল দিল্লির প্রাচীন সব অপরাধ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩, ০৮:০০ পিএম
প্রায় দেড়শো বছর আগে ১৮৭৬ সালে জানুয়ারির এক শীতের রাত। দুই ক্লান্ত পথিক কড়া নাড়ে দিল্লির সাবজি মান্ডি এলাকায় মোহাম্মদ খানের বাড়িতে।
ভারতের রাজধানীর এই এলাকা সরু অলি গলিতে ভর্তি। দুই পথিক রাতের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করেন মোহাম্মদ খানের কাছে।
খান বেশ সাদরেই অতিথিদের তার নিজের ঘরে ঘুমাতে দেন। কিন্তু সকালে উঠে আবিষ্কার করেন লোক দুটি হাওয়া। সেইসঙ্গে তিনি তাদের ঘুমানোর জন্য যে তোশক দিয়েছিলেন সেটিও গায়েব। খান বুঝতে পারেন তিনি এক অভূতপূর্ব চুরির শিকার হয়েছেন।
ঘটনার প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, খানের সেই দুর্ভাগ্যের কাহিনী উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া দিল্লির প্রাচীনতম সব অপরাধ তালিকায় - যে রেকর্ডগুলো দিল্লি পুলিশ তাদের ওয়েবসাইটে গত মাসে আপলোড করেছে।
এই ‘অ্যান্টিক এফআইআরস’ এরকম আরো ২৯টি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছে, যেগুলো শহরের পাঁচটি প্রধান পুলিশ স্টেশনে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। থানাগুলো হল – সাবজি মান্ডি, মেহরাউলি, কোতয়ালি, সদর বাজার এবং নাঙলোই।
ওই এফআইআরগুলো করা হয় ১৮৬১ থেকে ১৯০০ সালের ভেতরে। খানের ঘটনায় পুলিশ লোক দুজনকে গ্রেফতার করে এবং চুরির দায়ে তাদের তিন মাসের জন্য কারাগারে পাঠায়।
এই এফআইআরগুলো হাতে লেখা হয়, শুদ্ধ উর্দু শিকাস্থা স্ক্রিপ্টে-যেখানে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দের ব্যবহার রয়েছে।
দিল্লি পুলিশের সহকারি কমিশনার রাজেন্দ্র সিং কালকালের নেতৃত্বে একটি দল এই এফআইআরগুলো অনুবাদ করে সেগুলো সংকলন করেছে। প্রতিটি ঘটনার ইলাসট্রেশন করেছেন রাজেন্দ্র সিং নিজে।
কালকাল বিবিসিকে বলেছেন, এই রেকর্ডগুলো যেন ‘তার সঙ্গে কথা বলেছে’ কারণ এগুলো এমন একটা শহরের মানুষদের জীবনের উপর আকর্ষণীয় অর্ন্তদৃষ্টি দিয়েছে যে শহর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন - ফাইলগুলো অতীতের পাশাপাশি বর্তমানেরও একটা জানালার মতো।
বেশিরভাগ অভিযোগ অবশ্য সামান্য চুরির মতো অপরাধ নিয়ে – কমলা, বেডশিট অথবা আইসক্রিম চুরি, যা অনেকটা হাস্যরসের খোরাক মনে হতে পারে।
একদল লোক একবার এক রাখালের উপর আক্রমণ করে, তাকে চড় থাপ্পড় মারে ও তার ১১০টি ছাগল ছিনিয়ে নেয়। আরেকজন একটা বেডশিট প্রায় চুরি করে ফেলেছিল কিন্তু ঘটনাস্থলের ‘৪০ ধাপের মধ্যেই’ ধরা পড়ে যায়।
আবার দর্শন নামে এক চটের বস্তার মালিক, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঠগদের হাতে বেদম মার খান এবং তারা তার লেপ ও একজোড়া জুতার মধ্যে একটি নিয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু যাদের ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জানাশোনা আছে, তাদের কাছে এসব একটু বেখাপ্পা মনে হতে পারে, বিশেষ করে দিল্লির ইতিহাসে ১৮৬০ এর সময়টা যখন ভীষণ উত্তেজনার।
তার কয়েক বছর আগে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ যেটিকে অনেকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে থাকেন, ব্রিটিশরা সেটি দমনের মাধ্যমে মাত্রই মুঘল শাসনের ইতি ঘটেছে।
দিল্লি শহরটি যেখানে মুঘল রাজকীয় সব নির্দশন, শিল্পকলা, সুফি দর্শন আর আনন্দময় বাগানে ভরা ছিল – সেটি তখন পরিত্যক্ত ও লুটপাটের এক শহর।
শিল্পী ও ঐতিহাসিক মাহমুদ ফারুকী মনে করেন সেসময় তেমন মারাত্মক কোন অপরাধ সংঘটিত না হবার একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, মানুষ তখন ব্রিটিশদের কঠোর শাসনে ভীত ছিল।
বিশেষ করে বিদ্রোহের পরের বছরগুলোতে ব্রিটিশরা প্রচন্ড কড়া শাসন চালু রাখে। নারী, পুরুষ ও শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। অনেককেই দিল্লি থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয় এবং তারা তখন আশপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেন।
আর অল্প যে কজন শহরে থেকে গিয়েছিল তারা প্রতিনিয়ত গুলি খাওয়ার বা ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার অবিরাম ভীতির মধ্যে বাস করছিলেন।
ফারুকী আরো বলেন, অন্যান্য শহর যেমন কলকাতা সেখানে ইতিমধ্যে আধুনিক পুলিশি কাঠামো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু দিল্লি অনেকটা পুরোনো পদ্ধতির মুঘল আমলের পুলিশি ব্যবস্থাতেই চলতে থাকে, যা আসলে পুরোপুরি বাতিল করা বা বদলে ফেলা ছিল কঠিন। তাই রেকর্ডে অসঙ্গতি বা ফাঁক থাকার ব্যাপারটিও পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এই রেকর্ডগুলি যা এখন দিল্লি পুলিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে, তা গত বছর আবিষ্কার হয়। এই মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ত্বের গবেষণা ও সংরক্ষণের প্রধান কালকাল বলছিলেন, একদিন পুরনো আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই এগুলো আবিষ্কার করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি দেখলাম শতশত এফআইআর অন্ধকারে পড়ে রয়েছে। যখন আমি এগুলো পড়লাম তখন বুঝতে পারলাম যে কীভাবে ২০০ বছরেও এই ফরম্যাটটা অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে।
কালকাল জানান, তিনি অপরাধের নিরীহ প্রবৃত্তি দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন। এমন একটা সময় যখন সিগারেট, পায়জামা বা কমলার মতো জিনিস চুরি করা ছিল 'সবচেয়ে খারাপ বিষয়'।
তবে ঘটনা হল এ সমস্ত সামান্য অপরাধগুলো পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে মানে এই না যে অন্য আরো ভয়ানক অপরাধ সেইসময় ঘটছিল না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা