পুতিনের বিশ্বস্ত ‘বাবুর্চি’ এখন বিশ্বাসঘাতক বিদ্রোহী
শাবনুর নাহার
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৩, ০৯:৫২ পিএম
রুশ সেনাদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলা ওয়াগনার গোষ্ঠী ছিল ইউক্রেনে হামলার বড় হাতিয়ার। পরম বন্ধু হয়ে ঘাড়ে ঝুলে থাকা সেই অস্ত্রেই এখন রক্ত ঝরছে পিঠে। বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর মতো পেছন থেকে হামলা করেছে। অথচ রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনই (৬২) ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্টদের একজন। যাকে পুতিনের বিশ্বস্ত বাবুর্চিও বলা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই ফাটল ধরল! শুক্রবার গভীর রাতে বিদ্রোহের ঘোষণা দেন পুতিনের বিরুদ্ধে। বিবিসি, আলজাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস।
মাস কয়েক আগেই রাশিয়ার স্বার্থে ইউক্রেনের বাখমুত শহর দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে ওয়াগনার গোষ্ঠী। রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে মন কষাকষির শুরুটাও সেখান থেকেই। যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র দরকার। কিন্তু মস্কো থেকে চাহিদার সিকি আনা গোলাবারুদও সরবরাহ করছে না বলে অভিযোগ করেন প্রিগোজিন। সেই থেকেই মূলত পুতিন-প্রিগোজিন গৃহদাহের শুরু।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রিগোজিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উগ্র-ডন ব্লগারদের ওপর কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা হয়। তার মালিকাধীন একটি ক্যাফেতেও হামলা হয়। রুশ সরকার ইউক্রেনকে দ্বায়ী করলেও, প্রিগোজিন এটিকে আন্তঃরাশিয়ান যুদ্ধ বলে দাবি করেন।
‘দ্য শ্যামড’ নামক একটি সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন প্রিগোজিন। চুরি ও ডাকাতির দায়ে অনেকবার কারাভোগ করেন প্রিগোজিন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই (১৯৭৯) প্রথমবারের মতো আড়াই বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেন।
সর্বশেষ ১৯৮১ সালে ডাকাতির অভিযোগে ১২ বছরের সাজায় ৯ বছর জেল খাটেন। কারাভোগ শেষে ১৯৯০ সালে শুরু করেন হটডগের ব্যবসা। সেন্ট পিটার্সবাগে হটডগ বেচতে দোকান খুলে ফেলেন। পরে কৌশলে একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ খুলে ফেলেন। ইউক্রেনীয় তথ্যনীতির সাবেক উপমন্ত্রী দিমিত্র জোলোতুখিন জানান, রেস্তোরাঁগুলোতে মাফিয়া বৈঠকের আয়োজন হতো। পুতিন বন্ধুমহল নিয়ে প্রয়ই আসতেন প্রিগোজিনের রেস্তোরাঁয়। যা তার ক্যাটারিং ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করে তোলে।
এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি প্রিগোজিনকে। পুতিনের সঙ্গে মাখামাখির সূত্র ধরে রুশ সামরিক বাহিনীতে খাদ্য সরবরাহ চুক্তিও দেওয়া হয় তাকে। মস্কোর স্কুলগুলোতে খাবার সরবরাহের চুক্তিও পান তিনি। তবে খাবারে স্বাস্থ্যমান বজায় না রাখার অভিযোগও আছে তার ওপর। একটি ভাসমান রেস্তোরাঁরও মালিক প্রিগোজিন। যেখানে পুতিনসহ ফ্রান্সের সাবেক রাষ্ট্রপতি জ্যাক শিরাক ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আসা যাওয়া ছিল। ২০০২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিও বুশকেও আপ্যায়ন করা হয় এখানে। দিন দিন প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তার। প্রিগোজিন জীবনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় যখন পুতিন তাকে ক্রেমলিনের শেফ হতে বলেন।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশদের আগ্রাসন শুরু হয়। ইউক্রেনে রুশদের সর্বাত্মক আগ্রাসন ঘটে ২৪ ফেব্রুয়ারি। যা প্রিগোজিনের জীবনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। যুদ্ধ যত খারাপের দিকে গেছে প্রিগোজিনের ভবিষ্যৎ ততই সামনে এগিয়েছে। ভাড়াটে ব্যবসায় নাম ওঠে তার। হয়ে ওঠেন রুশদের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রের একটি গ্রুপের নেতা। ইউক্রেনীয়রা যত বেশি রুশ সেনাদের হত্যা করেছিল, মস্কোর তত বেশি ওয়াগনারের ভাড়াটেদের প্রয়োজন ছিল। সম্পদ ও চাকচিক্যের স্বাদ পেয়ে ক্ষমতার করিডোরে নিজের স্থান তৈরি করে ফেলেন প্রিগোজিন।
বর্তমানে তার সম্পদ ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। তার স্ত্রী ল্যুবভ প্রিগোজিনা একজন ফার্মাসিস্ট। ১০৫ মিলিয়ন ডলারের সেন্ট পিটার্সবার্গ এস্টেটে বাস করেন। অনেক হোটেলের মালিক ছিলেন যেগুলো এখন একটি বুটিক হোটেলে বিস্তৃত হয়েছে। তার মেয়ে পলিনার জন্যও একটি বিলাসবহুল বাড়ি অন্তর্ভুক্ত ছিল। হটডগ বিক্রি করা প্রিগোজিনের জীবন এখন অগাধ সম্পদে ভরপুর।