Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

বলিভিয়ায় যেভাবে ধরা পড়েছিলেন চে গুয়েভারা

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ০৬:৩৬ পিএম

বলিভিয়ায় যেভাবে ধরা পড়েছিলেন চে গুয়েভারা

বলিভিয়ার যে জেনারেল ১৯৬৭ সালে মার্কসবাদী বিপ্লবী এর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে আটকের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি এ সপ্তাহে ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচিত হচ্ছে চে গুয়েভারাকে আটক এবং তাকে হত্যার সেই বিতর্কিত ঘটনা।

১৯৬৭ সালে গারি প্রাডো সালমন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে চে গুয়েভারার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট গেরিলা দলের বিরুদ্ধে বলিভিয়ায় এক সামরিক অভিযান চালান। সেসময় বলিভিয়ায় ক্ষমতায় ছিল একটি দক্ষিণপন্থী সামরিক সরকার।

যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের উত্তেজনা তখন চরমে। লাতিন আমেরিকায় কমিউনিস্টদের প্রভাব নিয়ে ওয়াশিংটন তখন বেশ উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে চে গুয়েভারার তৎপরতা নিয়ে।

কিউবায় ১৯৫৯ সালের সফল বিপ্লবের পর চে গুয়েভারা সেখান থেকে অন্যান্য দেশের গেরিলা লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে চলে যান। তিনি কিউবান কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন, এবং সারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের কাছে এক বিরাট নায়কে পরিণত হন।

যে বলিভিয়ান অফিসার চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করেন তার নাম ছিল মারিও টেরান। তিনিও গত বছর মারা যান।

চে গুয়েভারার গেরিলা ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাকে ধরতে সফল হওয়ার পর জেনারেল প্রাডোকে পরে সেদেশে জাতীয় বীর বলে ঘোষণা করা হয়। কারণ তখন তিনি বলিভিয়ার সেসময়কার সামরিক শাসকদের রক্ষা করেছিলেন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া বলিভিয়ান সেনাদের একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দূর্গম জঙ্গলে নিয়ে যান, যেখানে চে গুয়েভারার গেরিলা দল অবস্থান করছিল। শুরুতে এই গেরিলা দলে প্রায় ১২০ জন সদস্য থাকলেও পরে তাদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২ জনে।

চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয়েছিল বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামে, যেটির অবস্থান লা পাজ থেকে ৮৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে। তাকে একটি গুপ্ত স্থানে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৭ সালে চে গুয়েভারার দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর কবর থেকে তুলে তা কিউবায় ফেরত পাঠানো হয়। এরপর সেখানে তাকে আবার কবর দেয়া হয়।

চে গুয়েভারা ধরা পড়েছিলেন ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর। সিআইএ’র এজেন্ট ফেলিক্স রড্রিগেজ চে গুয়েভারাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছিলেন। বিবিসির মাইক ল্যানচিনকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রড্রিগেজ এই কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন।

ফেলিক্স রড্রিগেজ তার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ’র হয়ে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

চে গুয়েভারাকে মেরে ফেলার আগে তার কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তিনি সংগ্রহ করেন, তার সঙ্গে ছবিও তোলেন।

ফেলিক্স রড্রিগেজ বলেন, ‘চে তার বিশ্বাস বলিভিয়াতেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলিভিয়ার প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেন। বলিভিয়া ছিল অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। তিনি মনে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এরকম দরিদ্র একটি দেশের ব্যাপারে আগ্রহী হবে না।’

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তখন বলিভিয়ায় যা কিছু ঘটছে তার ওপর কড়া নজর রাখছিল। স্নায়ু যুদ্ধ তখন একদম চরমে। আর চে গুয়েভারার তখন লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রেরই কাছের কোন দেশে কিউবার স্টাইলে বিপ্লব করা।

কিউবায় প্রেসিডেন্ট বাতিস্তার জীবনে যা ঘটেছে সেটা দেখে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলেন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে বেরিয়েন্টো। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চান।

যুক্তরাষ্ট্র তখন বলিভিয়ার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলো কমিউনিস্ট গেরিলাদের মোকাবেলায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫ জন সামরিক উপদেষ্টা বলিভিয়া গিয়ে পৌঁছালেন।

ফেলিক্স রড্রিগেজ বলেন, ‘সিআইএ’র এক অফিসার মায়ামিতে আসলেন। তিনি মোট ১৬ জনের সাক্ষাৎকার নিলেন। এদের মধ্য থেকে আমি সহ দুজনকে বাছাই করলেন বলিভিয়াতে পাঠানোর জন্য। আমাদের কাজ ছিল চে গুয়েভারা বলিভিয়ার যে এলাকায় কাজ করতেন, সেখান থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা।’

চে গুয়েভারা বলিভিয়াতে গিয়ে পৌঁছান ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে। একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে যান গহীন জঙ্গলে। সঙ্গে করে তিনি কিউবা থেকে অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের একটি দলও নিয়ে গিয়েছিলেন। বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই যোদ্ধারা প্রাথমিক কিছু সাফল্য পেয়েছিল, তবে গেরিলাদের তখন বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

চে গুয়েভারার ছিল অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট। একারণে তার বাহিনীর গতি শ্লথ হয়ে আসে। অ্যাজমার ওষুধ সংগ্রহ করা কঠিন হবে, সেরকম জায়গায় তারা যেতে পারতেন না। এই ওষুধের জন্য যখন তারা একটি গ্রামে খোঁজখবর করতে গেলেন, তখন অনুচররা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

সেই দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর। গভীর সংকীর্ণ এক উপত্যকায় বলিভিয়ার সেনাবাহিনী চোরাগোপ্তা হামলা করলো চে গুয়েভারার গেরিলা বাহিনীর ওপর। চে আহত অবস্থায় ধরা পড়লেন।

ফেলিক্স রড্রিগেজ বলেন, আমি তখন ভায়াগ্রান্ডিতে। বলিভিয়ার বিমান বাহিনীর জন্য কিছু যন্ত্রপাতি পাঠানো হচ্ছিল। তখন আমরা জানতে পারি যে চে গুয়েভারাকে ধরা হয়েছে। তাকে দেখার জন্যও আমার মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। পরের দিন একটা হেলিকপ্টারে করে আমি একটা স্কুলে যাই। যেখানে চে গুয়েভারাকে রাখা হয়েছিল। আমরা সবাই একটা ঘরে ঢুকে দেখলাম তাকে বেঁধে এক কোনায় মেঝের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে।

সেই ঘরে চে গুয়েভারার সামনে পড়েছিল কিউবার কয়েকজন কর্মকর্তার মৃতদেহ, যারা মারা গিয়েছিল অভিযানের সময়। রড্রিগেজ সেখানে একটি ঝোলা খুঁজে পান, যার মধ্যে ছিল চেগুয়েভারার একটা ডায়েরি, অ্যাজমার কিছু ঔষধ, এবং কমিউনিস্ট চীনের একটা কোড বুক।

চে গুয়েভারাকে ধরতে পারা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট এক সাফল্য। ফেলিক্স রড্রিগেজও এই প্রথম তার তার শত্রুর মুখোমুখি হলেন।

তিনি বলেন, পরে আমি ওই ঘরে একাই গিয়েছিলাম। ওর সামনে দাঁড়ালাম। বললাম, চে, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। মেঝেতে বসে থেকে সে ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকালো। বললো, আমার সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারে না, আমাকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারে না। আমি বললাম, কমান্ডার, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি যা ভাবছেন, সেটা ভুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, জিজ্ঞাসাবাদ করতে নয়। চে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কথা বলতে শুরু করলো।

রড্রিগেজ বলেন, যতবারই আমি তাকে প্রশ্ন করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বের করার চেষ্টা করেছি, তিনি আমাকে বলেছেন, না, আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না। একটা সময় তিনি কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু আমার তাতে মনোযোগ ছিল না। আমি ভাবছিলাম খবরে আমি যে মানুষটাকে দেখেছি, বড় কোট পরা উদ্ধত একজন মানুষ, লাল চীনে গিয়ে মাও জেদং এর সঙ্গে কথা বলছেন, সেই লোকটাকে এখন দেখা যাচ্ছে ভিক্ষুকের মতো।

ফেলিক্স রড্রিগেজ বলেছেন, তার নির্দেশনা ছিল খুব পরিষ্কার। সিআইএ চে গুয়েভারাকে জীবন্ত দেখতে চায়। তার কাছ থেকে আরও তথ্য বের করার জন্য। কিন্তু বলিভিয়ার সামরিক বাহিনী তাকে মৃত দেখতে চেয়েছিল।

চে গুয়েভারাকে মেরে ফেলার নির্দেশটি এসেছিল বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। কর্নেল সান্তিনারি তখন রড্রিগেজকে বলেছিলেন, তিনি দুপুর পর্যন্ত চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন, তারপর যেন চে’র মৃতদেহ নিয়ে তার কাছে আসেন। এরপর রড্রিগেজ আবার চে’র ঘরে যান।

তিনি বলেন, তারপর আমি ওই ঘরে গেলাম। বললাম, কমান্ডার, আমি দুঃখিত, আপনার শেষ কোন কথা থাকলে বলতে পারেন, সেটা আপনার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেব। চে তখন বললেন, আমার স্ত্রীকে বলবেন, আবার বিয়ে করতে, এবং সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে। এটাই ছিল তার মুখ থেকে শেষ কথা। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা করমর্দন করলাম। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, আমরা তাকে গুলি করতে যাচ্ছি। তারপর আমি ঘর থেকে চলে গেলাম। একটা দশ বা একটা কুড়ি মিনিটের দিকে আমি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম।

চে গুয়েভারা এবং তার সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হলো ভায়াগ্রান্দি। তারপর সেই মৃতদেহ গোটা বিশ্বকে দেখানোর জন্য রেখে দেওয়া হলো।

সেখানে দু হাজারের মতো মানুষ অপেক্ষা করছিল। চারটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে এসেছিলেন বলিভিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল ও এডমিরালরা। বিভিন্ন মিডিয়ার লোকজনও ছিল সেখানে।

এরপর গোটা পৃথিবী জানতে পারলো, চে গুয়েভারা ধরা পড়েছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে।

চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফেলিক্স রড্রিগেজের মিশনের সমাপ্তি ঘটলো।

কিন্তু তারও বহু আগে থেকে চে গুয়েভারা সারা পৃথিবীর মার্কসবাদী বিপ্লবীদের কাছে এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম