গত দুই দশক ধরেই বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণ-বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে দুবাই। ভারতের পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ আমদানিকারক দেশ। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ও অবৈধ বাণিজ্যের ওপর নজর রাখা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, শহরটি অর্থ পাচারকারী এবং স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের সরকারি কর্মকর্তারাও নিজেদের কালোটাকা সাদা করছে দুবাইয়ের এই সোনা কারবারিদের সঙ্গে মিশে। চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য হলো-জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট নানগাওয়ারও ‘গোল্ড মাফিয়া’দের একজন।
‘গোল্ড মাফিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত কাতার ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আলজাজিরার চার পর্বের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভয়ংকর এ চিত্র উঠে এসেছে।
তিন মহাদেশজুড়ে গোপনে কার্যক্রম চালানো কয়েক ডজন স্বর্ণ চোরাচালান চক্র এবং এ সংক্রান্ত হাজার হাজার নথি পর্যালোচনা করে আলজাজিরা অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের মাধ্যমে আমলা ও ব্যবসায়ীরা কীভাবে শত শত কোটি ডলার মুনাফা করছেন। বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারকারী ও চোরাচালানকারী চক্র কীভাবে দুবাইয়ের বিভিন্ন ব্যবসাবান্ধব নীতি ব্যবহার করে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করে, তা এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জিম্বাবুয়ের ‘স্বর্ণ চোরাচালানকারী’ ইয়ান ম্যাকমিলান। ছদ্মবেশে থাকা আলজাজিরার অনুসন্ধানী দলের সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে দুবাই। দুবাই, দুবাই, দুবাই।’
আলজাজিরার তথ্য মোতাবেক, জিম্বাবুয়ে থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রতিমাসে শত শত কোটি ডলারের স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে। এর মাধ্যমে অপরাধীরা তাদের কালোটাকা সাদা করছে। এটা করা হচ্ছে অসংখ্য অদৃশ্য কোম্পানি, নকল চালান ও সরকারের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। কীভাবে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়ার সরকার দেশের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচার জন্য স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের কাজে লাগাচ্ছেন, অনুসন্ধানে সেটাও উঠে এসেছে। প্রেসিডেন্ট নানগাওয়া এবং তার আশপাশেই থাকেন এমন সব কর্মকর্তাও জড়িত। অর্থ পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত আছেন জিম্বাবুয়ের প্রভাবশালী কূটনীতিকরাও। এসব চোরাকারবারির মধ্যে কোটিপতি ও ধনকুবেরও আছেন। দুবাইয়ের মুক্ত বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহজেই তাদের প্রতিষ্ঠান করার সুযোগ দেয়, যেখানে কর ও শুল্ক নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুব কম।
দেশটির ব্যবসায়িক নিয়মগুলো যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত মুনাফা এনে দেয়। তবে সমালোচকরা বলছেন, এসব নীতির কারণে বড় আর্থিক অপরাধগুলো করার সুযোগ তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সাবেক তদন্তকারী কারেন গ্রিনওয়ে আলজাজিরাকে বলেন, দুবাইকে আর্থিক রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। তারা স্বর্ণ ব্যবসার মাঝে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। কমলেশ পাটনি একজন স্বর্ণ চোরাকারবারি। তিনি এক সময় কেনিয়াকে প্রায় দেউলিয়া করার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। দুবাইয়ে তার একাধিক সংস্থা রয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তারা টাকা দিয়ে হিসাবের বাইরেও স্বর্ণ কিনে তা সংরক্ষণে রাখতে পারেন।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ২০২০ সালের গবেষণা অনুসারে, শিথিলভাবে নিয়ন্ত্রিত স্বর্ণ আমদানি প্রক্রিয়া, মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলে কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকিসহ নানা বিষয় মানি লন্ডারিং নেটওয়ার্কগুলোর জন্য একটি আশীর্বাদ।