
গান শুনতে সবাই কম-বেশি ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে বা অবসরে, মন ভালো কিংবা খারাপ, কোনো না কোনো কারণে আমরা গান শুনি। কিছু কিছু গান আছে যা সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, মন জয় করে নিয়েছে। বাংলা সিনেমায় কিছু গান গীতিকারের লেখনীর ছোঁয়ায়, সুরকারের প্রতিভায় আর সংগীতশিল্পীর কণ্ঠের জাদুতে কালজয়ী হয়ে উঠেছে। গানটি কার, সেটি কণ্ঠ শুনলেই বলে দেওয়া যেত, যা সিগনেচার ভয়েস সামে পরিচিত। গান এখনও হচ্ছে, বরং আগের তুলনায় বেশি। কিন্তু কার কণ্ঠে সেটাই বোঝা মুশকিল।
আমাদের দেশের সত্তর ও আশির দশকের কিছু গান আজও আমাদের মনে দাগ কাটে। সেসব কালজয়ী গান শুনলে আজও আমরা নস্টালজিক হয়ে যাই। সেসব গানের শিল্পীরা আজও শ্রোতা হৃদয়ে আসীন। তাদের গান ও কণ্ঠ মানুষের কাছে এতটাই পরিচিত যে, গান শুনলেই শ্রোতারা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারতেন সে শিল্পীর নাম। যা বর্তমান সময়ে পাওয়া খুব দুস্কর।
এখনকার সময়ে অনেকেই গান করছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনপ্রিয়। তবুও যেন কোথায় ঘাটতি রয়ে গেছে। আগেকার শিল্পীদের মতো সিগনেচার ভয়েস টাইপ শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। শুনলেই বোঝা যায় না এটি কার কণ্ঠ! এখন গানের সঙ্গে ভিডিও থাকে। তাই এটি গান নাকি নাচ, এ নিয়েও যেন একটি দ্বিধায় পড়তে হয় শ্রোতা-দর্শকদের, এমনটাও মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনেকেই বলছেন, এখনকার শিল্পীরা গানের পেছনে সময় কম দিচ্ছেন। তারা গানের থেকেও ভিডিও নিয়ে বেশি ভাবেন, সেখানে বেশি বাজেট ব্যয় করে থাকেন। অথচ তাদের প্রথম প্রাধান্য থাকার কথা ছিল গানে। এছাড়াও শিল্পীদের এখন নিজস্বতা নেই। অনেকেই মৌলিক গানে নজর না দিয়ে, কাভার গান বেশি করেন। এটা যদিও দোষের নয়, তবে একজন শিল্পীর পরিচিতি তৈরি হয় মৌলিক গানে। পুরোনো সেসব শিল্পীদের গান আজও কালজয়ী হয়ে আছে বা তারা (শিল্পীরা) শ্রোতাদের কাছে আজও পরিচিত তাদের মৌলিক গানের জন্যই। বর্তমান সময়ের তরুণ শিল্পীরা তাদের গানই কাভার করে রাতারাতি সেলিব্রেটি হওয়ার চিন্তা করেন। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে শিল্পী নিজেই তো টিকে থাকবে না, সেখানে সিগনেচার ভয়েস খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই দুস্কর।
একসময় সৈয়দ আব্দুল হাদি, মাহমুদুন নবী, খুরশীদ আলম, আব্দুল আলীম, আব্দুল জব্বার, খান আতা, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, ফরিদা পারভীন, ফেরদৌস ওয়াহীদ, মিতালী মুখার্জী, কনক চাঁপা, সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর, মনির খান, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, আবিদা সুলতানা, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, বাপ্পা মজুমদার, হাসান, আসিফ আকবরের মতো শিল্পীরা তাদের কণ্ঠের যাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন শ্রোতাদের। আজও তাদের কণ্ঠই যেন তাদের আইডেন্টটিটি। চোখ বন্ধ করে গান শুনে শ্রোতারা তাদের নাম বলে দিতে পারেন।
পরবর্তীতে হাবিব, বালাম, হৃদয় খান, আরফিন রুমি, ন্যান্সি, কনার মতো শিল্পীরা কণ্ঠ দিয়ে নিজেদের চেনাতে পারলেও, এদের পর উদাহরণ টানার মতো আর কোনো শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। সবাই গান করছেন, ভাইরাল হচ্ছেন, যা কয়েকমাস পর আর থাকছে না। শিল্পীদেরও নিজস্বতা তৈরি হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আব্দুল হাদি বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের সংগীতশিল্পীরা অনেক আধুনিক। ইন্টারনেটের যুগে সবাই এখন গানের সঙ্গে ভিডিও যোগ করছেন। তাতে করে গানের আবেদন কমছে। একজন শিল্পীর পরিচিতি তো তার গানে। সে গান থেকে যদি তার ভিডিও মানুষ বেশি দেখে তাহলে গানের আবেদন থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। শিল্পীদের নিজস্বতা আগে বজায় রাখতে হবে। তাদের গানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, অবশ্যই মৌলিক গানে। মৌলিক গান ছাড়া যেমন তার পরিচিতি আসবে না, তেমনি শিল্পী নিজে যদি পরিচিত না হয়, তাহলে তার কণ্ঠের পরিচিতি বা তার কণ্ঠ শ্রোতার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে না।
ফাহমিদা নবী বলেন, এখন তো গানই আর হয় না। যা হচ্ছে সব কনটেন্ট। যারাই গান করছেন, তারা গানের নামে কনটেন্ট তৈরিতে ব্যস্ত। আগেকার মতো শিল্পী এখন তৈরি হবে কিভাবে? সে ধৈর্য বা সাধনা কোনোটাই তো এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে নেই। সবাই ব্যস্ত রাতারাতি ভাইরাল হওয়া নিয়ে। গান তো ভাইরালের জিনিস নয়। শ্রোতার মনে স্থান করে নিতে হবে। তবেই না শ্রোতা তোমাকে মনে রাখবে, চোখ বন্ধ করলেই তোমার সেই কণ্ঠ ও সুর তার মনে বেজে উঠবে।