‘নিজের ঢোল নিজেই পিটাইবা, অন্যে রে দিলে ফাডাইয়া ফেলব’
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:১১ পিএম
![‘নিজের ঢোল নিজেই পিটাইবা, অন্যে রে দিলে ফাডাইয়া ফেলব’](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/06/abul-hayat-67a498c8cdb87.jpg)
মানুষটা ছিলেন চূড়ান্ত অগোছালো। তা সত্ত্বেও তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ আমাকে স্পর্শ করেছিল। সহকারীর সঙ্গে দাদার ঝগড়া। সহকারীকে বললেন—হায়াত রে স্ক্রিপ্টটা দাও। এদিকে সহকারী জানালেন, দাদা তাকে স্ক্রিপ্টই দেননি। দাদা সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। শেষে দাদা রেগে গিয়ে কাগজ ও কলম চেয়ে নিলেন। ঝড়ের গতিতে দৃশ্যটা লিখে ফেললেন।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তার থেকে অভিনয় শিখেছি। কাজের ধরন শিখেছি। মেকআপ করা শিখেছি। পরবর্তী জীবনে আমি তিন দশক পরিচালনার কাজ যখন করেছি, তখন দাদার সেই শিক্ষা আমাকে সাহায্য করেছে।
—এসব কথা জানালেন বাংলাদেশের বর্ষীয়ান অভিনেতা আবুল হায়াত। কিন্তু কার কথা বললেন অভিনেতা, যাকে হারিয়েও বেঁচে আছেন তার হৃদয়ে।
সেই তিনি হলেন— প্রয়াত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা ঋত্বিক ঘটক। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) একটি সংবাদমাধ্যমের পাতায় প্রয়াত পরিচালককে স্মরণ করলেন অভিনেতা আবুল হায়াত।
ঋত্বিকদার মৃত্যুদিনে অনেক স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় করছে। কারণ দাদার হাত ধরেই আমার সিনেমা জগতে প্রবেশ। সেই ছবির নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সব কথা লিখে বোঝাতে পারব কিনা জানি না। আমার বয়স হয়েছে। তবে এটুকু বলতে পারি— দাদার সঙ্গে কাটানো যাবতীয় স্মৃতি আমার মনে আজও টাটকা।
দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হয় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আমি তখন সরকারি চাকুরে। এদিকে নিয়মিত নাটক করি। তখন বাংলাদেশের নাটকে বিপ্লবের প্রভাব। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিয়মিত নাটক করা হচ্ছে। সেই নাটকগুলো মূলত পরিচালনা করতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি ছিলেন আমার স্থানীয় গুরু। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর এই ছবিটার কাজ যখন শুরু হয়, তখন সেখানে জড়িত ছিলেন হাসান ভাই। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় তিনি আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। আমার ইচ্ছে ছিলই। তার পর জানতে পারলাম, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক! সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। কারণ সেই সময়ে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন আমাদের আইকন। তার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘সুবর্ণরেখা’র মতো ছবি আমরা তত দিনে দেখে ফেলেছি।
হাসান ভাই আমাকে পর দিন নিয়ে গেলেন পুরান ঢাকার হাবিবুর রহমানের কোনো একটি বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম, ঋত্বিকদা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে রয়েছেন। যত দূর মনে পড়ছে— তার মুখে জ্বলন্ত সিগারেট বা বিড়ি। আলাপ পর্বের পর হাসান ভাইকে দাদা বললেন— এডারে কাল এফডিসিতে (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) লইয়া যাস। দাদা আর কিছু বললেন না দেখে আমি একটু হতাশই হলাম।
পর দিন এফডিসিতে গিয়ে দেখলাম ঋত্বিকদা আউটডোর শুটিং করছেন। আমাদের দেখে হাসলেন। তার পর মেকআপম্যানকে বললেন— এই ছেলেডার মাথায় একটা উইগ পরায়ে দাও তো। আমি একডু ঘুইরা আসতেছি। তখন আমার বয়স ২৫ বছর। কিন্তু মাথায় চুল কম ছিল। আমি তৈরি। আধ ঘণ্টা পর দাদা ফিরে এলেন। আমার মুখটা ধরে এদিক-ওদিক থেকে দেখলেন। তারপর উইগটা খুলে ফেললেন। দিয়ে বললেন, চুল ছাড়াই ভালো লাগতাসে। পাশ...! আমিও পাশ করে গেলাম।
তারপর আরিচাঘাটে শুটিংয়ের ডেট। তখন আমি সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। ছুটি নিয়ে ফ্লোরে গেলাম। প্রথম দিন দেখলাম, শুটিং হলো না। আবার একদিন গেলাম। সেদিনও আমার দৃশ্যের শুটিং হলো না। আমি দাদাকে বললাম যে, আমি তো আর ছুটি নিতে পারব না দাদা। জলবণ্টন বিভাগের কর্মী আমি। আপৎকালীন পরিষেবা। তাই ঘন ঘন ছুটি পাওয়া মুশকিল। দাদা শুনে বললেন— নায়িকাকে জলে ভেজানোর একটা দৃশ্য নিয়ে আমি ব্যস্ত। দেখছি আজকেই যদি তোমার শুটিং করতে পারি। আমিও খুশি হলাম। কিছুক্ষণ পরে দাদা ডেকে বললেন— আজ হইব তোমারডা।
দৃশ্যটা ছিল রোজীর (অভিনেত্রী রোজী আফসারী) পিছু পিছু আমি কবিতা বলতে বলতে হাঁটছি। তারপরে ঘড়া মাটিতে রেখে আমার গলায় টান দিয়ে পাঞ্জাবি ছেঁড়ার একটা দৃশ্য ছিল। শট শেষ হলো। সবাই খুব প্রশংসা করলেন। এদিকে আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া। রোজীর নখের আঁচড়ে আমার বুক ছিঁড়ে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে। দাদাকে গিয়ে বিষয়টি বললাম। দাদা হেসে রোজীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন— শক্তিশালী অভিনেত্রী। এমনই ছিল দাদার রসবোধ। তারপরও শুটিং করেছিলাম আরও দিন চারেক। তিনি যে ঋত্বিক ঘটক— সেটাই আমাকে কোনো দিন বুঝতে দেননি।
অভিনেতা বললেন, একটা ঘটনা মনে পড়ছে। শুটিংয়ের মাঝেই দাদা তখন বেশ অসুস্থ। ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় আমার নাটকের প্রশংসা পড়ে, দাদা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন—তুমি যে মঞ্চে অভিনয় করো, আমাকে তো জানাওনি! আমি বললাম যে, নিজের প্রশংসা নিজের মুখে করা ঠিক নয় দাদা। শুনে হাসলেন। তার পর বললেন— তোমারে একডা কথা কই, নিজের ঢোল নিজেই পিটাইবা। অন্যে রে দিলে কিন্তু ফাডাইয়া ফেলব।
শুটিংয়ের পর ঢাকাতেই ছবির ডাবিং শুরু হলো। দাদা বলেছিলেন, আগে যদি জানতেন যে আমি মঞ্চে অভিনয় করি, তা হলে আমার চরিত্রের দৈর্ঘ্য আরও বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু দাদার সঙ্গে কাজ করে আমার ততদিনে স্বপ্নপূরণ হয়ে গেছে। বললাম, বড় চরিত্র চাই না। আপনার সঙ্গে যেটুকু কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে, সেটাই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। সত্যিই অত বড় পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও দাদার থেকে আমি অনেক স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি।
আবুল হায়াত বলেন, অভিনেতা হিসেবে ঋত্বিকদার হাত ধরে আমার অভিনয় জীবনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে আমি গর্বিত। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মুক্তি পাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই রাজেনদা (পরিচালক রাজেন তরফদার) আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তার ‘পালঙ্ক’ ছবিতে আমি সুযোগ পেলাম। শেষের দিকে ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। পত্রপত্রিকা মারফত এবং কলকাতার কেউ ঢাকায় এলে দাদার খবর নিতাম। তখন তো মোবাইল ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকত।