‘সিটাডেল: হানি বানি’: হিংস্র অ্যাকশনের তোড়ে হারিয়ে গেল সম্পর্কের উপকাহিনি
বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি ‘সিটাডেল’ নামের সিরিজটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ‘সিটাডেল’ সিরিজটিতেই একসময় অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী প্রিয়াংকা চোপড়া। সেই জনপ্রিয়তার কিছুটা ব্যবসায়িক ছোঁয়া যাতে তাদের ভাগেও আসে, সে কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক ওটিটির ভারতীয় সংস্করণটির হিন্দি ভাষায় একই সিরিজ করার ভাবনাচিন্তা।
ভারতীয় সিরিজটির প্রথম পরিচ্ছেদটি পরিচালনা করেছেন রাজ নিধিমারু ও কৃষ্ণ ডি কে, যারা ভারতীয় দর্শকের কাছে রাজ ও ডি কে নামেই বেশি পরিচিত। তারা আগেও এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ নামে অন্য একটি বাণিজ্যিকভাবে সফল সিরিজ পরিচালনা করেছিলন। সেটি গুপ্তচরবৃত্তির ওপরেই মূলত অনুপ্রাণিত ছিল। তাই ‘সিটাডেল’ সিরিজ, যেটি একেবারেই গুপ্তচরবৃত্তির দ্বারাই অনুপ্রাণিত (যেমন মূল ‘সিটাডেল’), তেমন একটি গল্প পরিচালনার ভার নেওয়ার স্বাভাবিক পছন্দও তারা।
ভারতের ওটিটি বাজারে ‘সিটাডেল: হানি বানি’ মুক্তি পেয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। আর এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন বলিউড অভিনেতা বরুন ধাওয়ান ও অভিনেত্রী সামান্থা রুথ প্রভ। ছয় পর্বের ছবি প্রত্যেকটি ৪০ মিনিটের। প্রথম ও শেষ পর্ব দুটি একটু লম্বা। ৫০ মিনিটের সামান্য বেশি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টার সিরিজ। সমস্যা হলো— সম্পূর্ণ সিরিজটি ভীষণভাবেই ‘অ্যাকশন’নির্ভর। তার ওপর ভারতীয়। এ দেশের বেশিরভাগ পরিচালকের ধারণা— ভারতীয় দর্শক ‘অ্যাকশন’ -এর রস তখনই সম্পূর্ণ নিতে সমর্থ হন, যখন ‘অ্যাকশন’-এর সঙ্গী হয় আবহের নির্দয় আস্ফালন। ‘সিটাডেল: হানি বানি ’-তেও তার অন্যথা ঘটেনি।
সুতরাং ৬ ঘণ্টার কাছাকাছি আপনি যদি বিভীষণ আবহের নির্দয় অত্যাচার সইতে প্রস্তুত থাকেন, তা হলে হয়তো এ সিরিজটি দেখার সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন।
আলোচনার এ পর্যায়ে সিরিজের গল্পটি একটু ধরিয়ে দেওয়ার আছে। গল্পটি সম্পূর্ণভাবেই দুই গুপ্তচর সংস্থার রেষারেষির ওপর ভিত্তি করে রচিত। সুতরাং এমন কাহিনিতে গুলিগোলার বিনিময়, মুহুর্মুহু গাড়ি ধাওয়া, অনন্ত রক্তপাত ও খুনোখুনি ইত্যাদি হিংস্র দৃশ্যই যে মূলত প্রাধান্য পাবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। গুপ্তচরবৃত্তিতে যে সূক্ষ্ম বুদ্ধির খেলা আছে, সেটায় কোনো আজব কারণে সাম্প্রতিক ভারতীয় পরিচালকেরা বিশ্বাস করেন না। হয়তো কেউ-ই করেন না। কেন করেন না, তার কারণ কেউ জানেন কিনা জানি না, একমাত্র ভারতীয় দর্শক মস্তিষ্ককে দুর্বল বুদ্ধি ভাবা ছাড়া।
যাই হোক, সিরিজের কাহিনি বিস্তার এ দুই গুপ্তচর সংস্থার সভ্যদের বন্ধুত্ব, প্রেম, পারস্পরিক বোঝাপড়া, শত্রুতা, প্রতিশোধ ইত্যাদি নিয়েই। এর মধ্যে আবার যে সংস্থাটি ‘সিটডেল’ নামক প্রযুক্তিটি তৈরি করছে সেটি গৌন। সিংহভাগ গল্পই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাটিকে নিয়েই, যার কর্ণধার বাবা (কে কে মেনন)। এই বাবাই আবার পালিত পুত্রের মতো বড় করেছে বনিকে (বরুণ ধাওয়ান), যে আসলে অনাথ। বনির প্রেমিকা-বন্ধু-পরে প্রায়-স্ত্রী হানি (সামান্থা) আবার অবৈধ এক রাজকন্যা। বনি একই সঙ্গে মুম্বাইয়ের ছবির ‘স্টান্টম্যান’ এবং বাবার গুপ্তচর সংস্থার একজন অত্যন্ত কার্যকরী সদস্য। হানি দক্ষিণের বাসিন্দা, নিজের বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির ফলে ভাগ্যান্বেষণে মুম্বাই এসে ছবির দুনিয়ায় ঢোকে। সেখানে বনির সঙ্গে আলাপ হয়। বনির সহায়তায় সে বাবার দলে যোগ দেয় এবং বনির শিক্ষাতেই সেও একজন তুখোড় মারকুটে হয়ে ওঠে। এর মধ্যে নানা মারদাঙ্গার ঘটনা ঘটে, সেসবের মধ্যেই কোনো একসময়, যা সংলাপ থেকেই জানা যায়, বনি ও হানির সম্পর্ক গাঢ় হয়, যার ফলে নাদিরা, তাদের কন্যা।
সামান্থা আর বরুণের জুটি যেহেতু একেবারেই আনকোরা, সেহেতু তাদের খুবই টাটকা লাগে। তাদের কন্যার চরিত্রে যে বাচ্চাটি (কশভি মজুমদার) অভিনয় করেছে, তার অভিনয়ও বেশ নজরকাড়া।
কাহিনিতে অবশ্য এসব সম্পর্ক সম্পূর্ণ গৌন, মূল কাহিনি একেবারেই দুই গুপচর সংস্থার একে-অন্যকে টপকে যাওয়াতেই আটকে থাকে। সম্পর্কগুলি এসেছে মূলত উপকাহিনি হিসাবে। সুতরাং আবহের আস্ফালন, খুনোখুনি এবং রক্তপাতেই সিরিজ়টি ভর্তি। কাহিনির বিস্তার মুম্বই, বেলগ্রেড এবং দাক্ষিণাত্যের পটভূমিকায়। শুটিং হয়েছে এ দেশে এবং বেলারুশে। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি (জোহন হয়েউরলিন আইডিট), বিশেষত ‘অ্যাকশন’ এবং ধাওয়া করার দৃশ্যগুলি। তবে এটি অনস্বীকার্য, কাহিনি রোমহর্ষক যতটা, হৃদয়তন্ত্রীতে টান ততটা নেই। বলতে গেলে একেবারেই নেই।
তবে থাকতে পারত। যদি সম্পর্কের ছোট ছোট উপকাহিনিগুলোকে আরও বিস্তারিত করা যেত। আসলে কাহিনিতে নিহিত ছিল এক অমোঘ জীবনসত্য। প্রত্যেক মানুষই জীবনের কোনো না কোনো বাঁকে পৌঁছে, কোন পথটি বেছে নেবে, সেই প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়। কোনটি ভুল, কোনটিই বা ঠিক? সিদ্ধান্ত কিন্তু ব্যক্তিগত। সাধারণত মানুষ হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল পথটি বেছে নেয় এবং সেই সিদ্ধান্তটিই তার জীবন গোলমাল করে দেয়। সবসময় যে সেটি ঘটে আপন দোষে তা-ও নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিপার্শ্বিক চাপ তাকে প্রভাবিত করে। এই সত্য অবশ্য নতুন কোনো সত্য নয়। মহান যে কোনো চিন্তাই অনেক আগেই নির্মিত হয়েছে। তবে সে কারণেই জগতে কিছু গল্প ‘ট্র্যাজেডি’ হয়। আবার ‘ট্র্যাজেডি’ও যে সবার জীবনে বিয়োগান্তক, তারও কোনো মানে নেই। যে কোনো ঘটনাতেই কেউ না কেউ লাভবান হয়ই।
এটিই এই কাহিনির সবচেয়ে দুঃখের দিক। রাজ এবং ডিকে কিন্তু চাইলে কাহিনির ভিতর এই নিহিত ফল্গুধারাটিকে একটি অন্য মাত্রা দিতে পারতেন। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ (শুরু ২০১৯) সিরিজটিতে কিন্তু নায়কের পারিবারিক টানাপোড়েন আর গুপ্তচরবৃত্তির চাপ সমান্তরালভাবে এগোয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে যত সফল পরিচালকই হন বা যত মেধাবিশিষ্ট স্রষ্টা, আসলে কোনো সিরিজই তো সহজে শেষ করা যায় না। পরের পর্বে তা হলে কীসের ভিত্তিতে কাহিনি এগোবে? আর ‘সিটাডেল: হানি বানি’র এই তো সবে প্রথম পরিচ্ছেদ।