ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী বলেছেন, আর কত? এখন অবসর নেওয়ার পালা।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনি কেমন আছেন?
সব্যসাচী: এখন ভালোই আছি। তাই তো শুটিং করছি।
প্রশ্ন: কিন্তু মার্চ মাসে আপনার শারীরিক অসুস্থতা...
সব্যসাচী: এক মাস আগে আমার স্ত্রীর ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার। তার পরেই আমি পাল্স ৩৪! বুকে পেসমেকার বসল। ডাক্তার জানালেন, তিন মাস বিশ্রামে থাকতে হবে। একদম জর্জরিত হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনাকে এখন ফোনেই পাওয়া যায় না! কী ব্যাপার বলুন তো?
সব্যসাচী: (মুচকি হেসে) আমি এখন একদম ফোন থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলে ধরি না। যাদের প্রয়োজন আগে আমাকে মেসেজ বা হোয়াট্সঅ্যাপ করতে পারেন। তারপর আমি ঠিকই জবাব দেব।
প্রশ্ন: আপনি তো এখন কাজের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন।
সব্যসাচী: কিছুই করছি না! প্রায় বছর দুয়েক আগে থেকে এটা শুরু হয়েছে। কোনও কিছুই ভালো লাগছে না। কাজ কমিয়ে দিলাম। ফেলুদা আর করলাম না। ফলে ভালো লাগার জায়গাটাও বন্ধ হয়ে গেল।
প্রশ্ন: কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আপনার অবসর গ্রহণের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিস্তর জলঘোলা হয়।
সব্যসাচী: আসলে তখন আমার বক্তব্যের ভুল ব্যখ্যা করা হয়। আমি বলেছিলাম, আর ফেলুদা করব না। কিন্তু লেখা হলো যে, ‘সব্যসাচী চক্রবর্তী আর অভিনয় করবেন না!’
প্রশ্ন: কিন্তু, এখন কি আপনি অবসর নিতে চাইছেন?
সব্যসাচী: হ্যাঁ, এখন আমি অবসর গ্রহণ করতে চাইছি। কারণ আমার এখন আর করার মতো কোনও চরিত্র নেই।
প্রশ্ন: ফেলুদার বাইরেও তো চরিত্র রয়েছে। প্রস্তাব তো আসে নিশ্চয়ই।
সব্যসাচী: আমাকে বলা হল, ‘আপনি না থাকলে ছবিটা হবে না।’ কী চরিত্র জিজ্ঞাসা করতে বলা হল, হিরোর বাবা। দেখা যাবে, হয়তো তার আগের ছবিগুলোতেও একই চরিত্র এবং একই সংলাপ। আমার যুক্তি, নতুন কিছু না হলে আমি অভিনয় করব না।
প্রশ্ন: ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিতে তাহলে অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন?
সব্যসাচী: শুভ্রজিৎ খুব ভালো পরিচালক। ওর প্রথম ছবি ‘আগুনপাখি’তে একটা সুন্দর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। কোনও অজ্ঞাত কারণে ছবিটা মুক্তি পায়নি। ও যখন ‘অভিযাত্রিক’-এর প্রস্তাব দেয়, তখনও আমি অবাক হই। কারণ আমি নাকি শঙ্কর! তারপর ছবিটা প্রশংসিত হলো। তারপর এই ছবিটার প্রস্তাব এল। প্রথমে রাজি হইনি। জোর করে আমাকে নিল। তারপর আটকে গেল ছবি (হাসি)! আমার জন্য ওদের খুব ভুগতে হলো।
প্রশ্ন: বাংলায় তাহলে নতুন চরিত্র তৈরি হচ্ছে না বলতে চাইছেন।
সব্যসাচী: আসলে শহুরে বহুতলের দর্শকের কথা ভেবে ছবি তৈরি করা হলে, এটাই হবে। নেপথ্যে থাকেন কিছু মার্কেট অ্যানালিস্ট। কী লিখতে হবে, তাঁরাই ঠিক করে দেন। আমি তখন পরিচালককে বলি যে, এই ধরনের ছবি দেখে শহরের বহুতলের দর্শক প্রশংসা করতে পারেন, কিন্তু বৈঁচি গ্রামের দর্শক ছবিটা দেখবেন না।
প্রশ্ন: এই দর্শক বিভাজনের প্রবণতা কি বাংলা ছবির ক্ষতি করছে বলে মনে হয়?
সব্যসাচী: গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত নন, এটা সবার বোঝা উচিত। তাদের একাংশ গরিব হতে পারেন, কিন্তু অশিক্ষিত নন। আসলে পার্থক্যটা সংস্কৃতিগত। গ্রামের মানুষও এখন জিন্স পরেন। তারাও মোবাইল ব্যবহার করেন এবং অনলাইনে কেনাকাটা করেন। গ্রামের দর্শক যে ছবি দেখেন, সেখানে সামাজিক মূল্যবোধ রয়েছে। সেই ছবিতে ভালো-খারাপের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। আমি স্পষ্ট বলে দিই যে, ছবি করতে চাই না, কারণ তিনি লিখতে পারছেন না।
প্রশ্ন: আপনি কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে চাইছেন?
সব্যসাচী: আমার বাড়ির কাছে যে বস্তিগুলো রয়েছে, সেখানকার বাচ্চাদের কাছে এখনও আমি ‘দেবের বাবা’ হিসেবে পরিচিত। কারণ তারা পরিবারের সকলের সঙ্গে দেখার মতো বিনোদনমূলক ছবিগুলো দেখে। চরিত্র নিয়ে আমার কোনও বাছবিচার নেই। ভাল বা খারাপ যে কোনও ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি। আমি কমেডিও করতে পারি, আবার ফেলুদার মতো অন্য ধরনের কোনও চরিত্র হলেও আমি রাজি। যেমন অনীকের (অনীক দত্ত) ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ তো করেছি। কিন্তু, তার আগে চরিত্রটাকে মনের মতো হতে হবে।
প্রশ্ন: হিন্দি ছবির প্রস্তাবও কি ফিরিয়ে দিচ্ছেন?
সব্যসাচী: গত দুই বছরে ছবি এবং সিরিজ মিলিয়ে অন্তত ২২টা হিন্দি কাজ ফিরিয়ে দিয়েছি। ফোন এলে সোজা বলে দিই, আমি এখন কাজ করছি না। ইচ্ছে হলে আমি ফোন করে নেব। বাংলার তুলনায় বলিউডের বেশি কাজ ফিরিয়েছি। কাজ করব না মানে বাংলা, হিন্দি কোথাও করব না।
প্রশ্ন: আপনার অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তকে পরিবারের সদস্যরা কি সমর্থন করেছেন?
সব্যসাচী: ওদের প্রত্যেকেরই খুব আপত্তি। সবচেয়ে বেশি আপত্তি আমার স্ত্রীর। কারণ ওর মতে, আমি খিটখিটে বুড়ো হয়ে বাড়িতে বসে থাকব (হাসি)।
প্রশ্ন: বাড়িতে তা হলে এখন কী ভাবে আপনার সময় কাটে?
সব্যসাচী: তিনটে বই লিখে ফেলেছি। বাবার নাটকের সংগ্রহ তৈরি করলাম। শারদীয়ায় লিখলাম। বাড়িতে সিনেমা দেখি। আগে শুটিংয়ের জন্য খেলা দেখার সময় পেতাম না। এখন বাড়িতে ক্রিকেট এবং ফুটবল দেখি। ফর্মুলা ওয়ান, টেনিসও দেখি। ইলেকট্রনিক কিছু প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। দিব্যি সময় কেটে যায়।
প্রশ্ন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর আপনার ফেলুদা হিসেবে জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। আর স্বয়ং সব্যসাচীর সেই ফেলুদা পছন্দ হচ্ছে না!
সব্যসাচী: হ্যাঁ। কারণ এখন দেখলে মনে হয়, আমি আরও ভালো করতে পারতাম। তবে কয়েকটা জায়গায় শুধু মনে হয় যে, মন্দ করিনি।
প্রশ্ন: অন্যদের অভিনীত ফেলুদা দেখেন?
সব্যসাচী: সকলের ফেলুদা দেখেছি। শুধু পরমের (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সাম্প্রতিক ফেলুদা দেখা হয়নি। টোটা (টোটা রায়চৌধুরী), আবীর (আবীর চট্টোপাধ্যায়), ইন্দ্রনীল (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)— সকলের ফেলুদা দেখেছি। এমনকি বাংলাদেশে আহমেদ রুবেল অভিনীত ফেলুদাও দেখেছি। কিন্তু কোনো তুলনায় যেতে চাই না। কারণ তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে ভালো অভিনয় করেছেন।
প্রশ্ন: আপনার অভিনীত ফেলুদার জনপ্রিয়তার নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে বলে মনে হয়?
সব্যসাচী: বলা কঠিন। আমাকে কেউ বলেন, আমার কণ্ঠস্বর। আমি তাদের বলি, তা হলে তো কোনও বাচিকশিল্পী অভিনয় করলে ভাল হত। কেউ বলেন, আমার চেহারা। তাদের বলি, আমার মতো দাগ অন্য কারও মুখে নেই। আর যারা বলেন, আমার উচ্চতা, তাদের প্রশ্ন করি, তা হলে কি দ্য গ্রেট খলি অভিনয় করলে আরও ভাল হত! যিনি বলেন, আমার অভিনয়, তাকে বলি, কী এমন অভিনয়, যার জন্য কোনও দিন আমি কোনও পুরস্কার পাইনি!
প্রশ্ন: তার জন্য কোনো খারাপ লাগা...
সব্যসাচী: (থামিয়ে দিয়ে) একদম নয়। অজস্র অভিনেতা ছিলেন বা রয়েছেন, যারা সারা জীবন তাদের মতো করে লড়াই করে গিয়েছেন এবং ভালো অভিনয় করে গিয়েছেন। অথচ তারা প্রাপ্য সম্মান পাননি। কেন? উত্তমকুমারের থেকে তুলসী চক্রবর্তী, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কি অভিনয়ের নিরিখে কোনো অংশে কম ছিলেন! কিন্তু তাদের প্রত্যেককে একটা স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অতগুলো স্তম্ভ ছিল বলেই ‘উত্তমকুমার’ নামক বড় বাড়িটি দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রশ্ন: আজকের ইন্ডাস্ট্রিতে কি এ রকম স্তম্ভের অভাব রয়েছে?
সব্যসাচী: না না, বহু অভিনেতা রয়েছেন। রনি (রজতাভ দত্ত), রুদ্র (রুদ্রনীল ঘোষ) বা বিশ্বনাথ (বিশ্বনাথ বসু) কোনো দিন নায়কের চরিত্র পাবে না। কিন্তু এরা কোন নায়কের থেকে কম? তাই আমি ফেলুদা করলাম, সেটা মানুষের ভালো লেগেছে বলে যে মাটিতে আমার পা পড়ছে না— এটা খুবই খারাপ ধারণা।
প্রশ্ন: ব্যোমকেশকে নিয়ে বড় পর্দায় বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। ফেলুদার যদি কখনও বয়স বাড়ে, প্রস্তাব পেলে রাজি হবেন?
সব্যসাচী: তাহলে তো বাবুদা (সন্দীপ রায়) নিজেই লিখে ফেলতেন! সত্যজিৎ রায়ের লেখা অবলম্বনেই ফেলুদা তৈরি হবে। অন্য কেউ লিখলে বা এক্সপেরিমেন্ট করলে, সেটা অন্তত ‘ফেলুদা’ হবে না।
প্রশ্ন: আপনি সমাজমাধ্যমে নেই কিন্তু, আপনার অনুরাগীরা কি আপনার অবসরের সিদ্ধান্ত সমর্থন করবেন বলে মনে হয়?
সব্যসাচী: আমি নেই, কিন্তু আমার একটা ফ্যান ক্লাব আছে। সব মহিলা সদস্য এবং অল্পবয়সি (হাসি)। ওরা নাম রেখেছে ‘সব্যসাচী চক্রবর্তী ফ্যান আর্মি’। ওরা আমাকে খুবই সাহায্য করে। মাঝে আমার নামে ফেসবুকে একটা ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়। ওরাই কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে সেটা বন্ধ করায়। এখনো জন্মদিনে আমার বাড়িতে তারা কেক নিয়ে হাজির হয়। উপভোগ করি।