
প্রিন্ট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২০ এএম
সাক্ষাৎকার
সর্বোচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করি
সেলিম এইচ রহমান, চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, হাতিল কমপ্লেক্স লি.

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
প্রশ্ন : হাতিল ফার্নিচার দেশের সেরা ব্র্যান্ডের একটি। আজকের এ অবস্থানে আসার শুরুটা কেমন ছিল?
উত্তর : পৈতৃক কাঠের ব্যবসার হাত ধরে হাতিলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথমে একটি ছোট পরিসরে ৬-৭ জন কর্মচারী নিয়ে দরজা তৈরির কারখানা হিসাবে কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে আমরা সোফা, ডাইনিং টেবিল আলমারি, খাট ও অন্যান্য আসবাব তৈরির দিকে অগ্রসর হই। ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় হাতিল যান্ত্রিক উৎপাদনে রূপান্তরিত হয়। ২০০৪ সালে, আমরা সাভারে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন শুরু করি। ২০১৩ সালে, হাতিল তাদের প্রথম বিদেশি শোরুম অস্ট্রেলিয়ায় চালু করে এবং কুয়েত, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি শুরু করে। এরপর নেপাল, ভুটান ও ভারতে ফ্রাঞ্চাইজি/ডিলার শোরুম হিসাবে কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে। ২০১৯ সালে, হাতিল যন্ত্রপাতি উন্নত করতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে।
প্রশ্ন : গুণগত মান আর টেকসই বিবেচনায় আপনাদের ব্র্যান্ডের অবস্থান কোথায়?
উত্তর : গুণগত মান ও টেকসই পণ্যের ক্ষেত্রে হাতিল সর্বদা আপসহীন। আমরা (এফ.এস.সি প্রত্যয়িত) পরিকল্পিত বনায়ন থেকে কাঠ সংগ্রহ করি এবং উন্নতমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে আসবাবপত্র তৈরি করে থাকি। আমাদের পণ্যের প্রতিটি উপাদান আন্তর্জাতিক মানের এবং সেগুলো পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি। জার্মানি থেকে কাঠ, ইতালি থেকে লেকার এবং ফ্যাব্রিক্স ও হার্ডওয়্যার চীন থেকে সংগ্রহ করা হয়। কাঁচামাল সংগ্রহের সময় ফার্নিচারের স্থায়িত্বকে (durable) সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ফার্নিচার দীর্ঘ সময় কাস্টমারের ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য ডিজাইনের প্রতিও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কাস্টমার ফার্নিচার কেনার সময় একদিকে ফার্নিচারের ডিজাইন অন্যদিকে স্থায়িত্ব (durability) বিবেচনা করে থাকে। হাতিলে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ফার্নিচারের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। আমাদের পণ্যের স্থায়িত্ব এবং গুণগত মানের কারণে ক্রেতারা আমাদের ওপর নির্ভর করতে পারেন, যা আমাদের ব্র্যান্ডকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ফার্নিচার রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। তারপরও দেশটির মোট আমদানির এক শতাংশেরও কম হিস্যা বাংলাদেশের। রপ্তানি বাড়াতে করণীয় কী?
উত্তর : আমরা সব সময় আসবাবের সর্বোচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষে কাজ করি। আমাদের আসবাব তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, যার ওপর শুল্ক (ইমপোর্ট ডিউটি) এবং ভর্তুকি শুল্ক (সাবসিডি ডিউটি) দিতে হয়। এ অতিরিক্ত খরচ যোগ করেই যখন আমরা আমাদের পণ্য বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানি করতে যাই, তখন ক্রেতার জন্য সেটির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ে যায়। ফলে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে বেশ কষ্ট হয়। এটা শুধু হাতিলের জন্য নয়, পুরো আসবাব খাতই এ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে চীন সবচেয়ে বেশি ফার্নিচার রপ্তানি করে, তা ছাড়া ভিয়েতনাম ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফার্নিচার রপ্তানি করে। চীন ও ভিয়েতনামের ফার্নিচারের চেয়ে হাতিলের ফার্নিচারের গুণগত মান উন্নত। কিন্তু দামের দিক দিয়ে আমরা ওই দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আমদানি শুল্ক নীতি পরিবর্তন করে ফার্নিচার রপ্তানির পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
প্রশ্ন : ফার্নিচার শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক ব্যবস্থা খাতটিতে বিনিয়োগে কি প্রভাব ফেলছে?
উত্তর : শুল্ক ব্যবস্থা আমাদের শিল্পে বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। আমদানি শুল্ক বেশি থাকলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যা পণ্যের দাম বাড়ায়। এটি শুধু আমাদের ব্যবসায়িক মুনাফার ওপরই প্রভাব ফেলে না, বরং স্থানীয় ক্রেতাদের জন্য পণ্য মূল্যও বাড়িয়ে দেয়। শুল্ক হার কমানো গেলে বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহিত হবে এবং উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হবে।
প্রশ্ন : আপনাদের কোন ধরনের ফার্নিচারের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি? আপনাদের পণ্যের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?
উত্তর : হাতিল সব সময় ক্রেতার মনস্তত্ত্ব ও চাহিদা নিয়ে কাজ করে। আমরা ক্রেতার পছন্দকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং একইসঙ্গে পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখার বিষয়েও আপস করি না। আমরা আধুনিক ডিজাইন এবং স্পেস সেভিং আসবাব তৈরি করি, যা ক্রেতাদের দৈনন্দিন জীবনে সুবিধা আনে।
প্রশ্ন : আপনাদের ব্র্যান্ডের শুরুটা কীভাবে এবং কখন হয়েছিল?
উত্তর : হাতিলের যাত্রা শুরু হয় আমার বাবা, আলহাজ হাবিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত H.A. Timber Industries Ltd. থেকে, যা ১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠে। আমি ১৯৮৮-সালে বাবার এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে দরজা উৎপাদনের ধারণা নিয়ে আসি। এরপর, ১৯৮৯ সালে ‘হাতিল ডোর্স’ নামে একটি ছোট কারখানা দিয়ে হাতিলের যাত্রা শুরু করি পুরান ঢাকায়। ১৯৯৩ সালে কুড়িলে ৫ হাজার বর্গফুট জায়গায় আমরা কার্যক্রম প্রসারিত করি এবং আলমারি, বেডসহ অন্যান্য আসবাব তৈরিতে মনোনিবেশ করি। ২০০৪ সালে, হাতিল সাভারে আমাদের নিজস্ব কারখানা থেকে উৎপাদন শুরু হয়।
প্রশ্ন : দেশের ফার্নিচার শিল্পের বর্তমান অবস্থা কেমন বলে মনে করেন? চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো কী?
উত্তর : দেশ এখন কিছুটা অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এ শিল্পও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। আমরা আসলে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই, কারণ শিল্পটি এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ডলার সংকট, কাঁচামালের উচ্চমূল্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এর ফলে ক্রেতাদের ওপরও চাপ পড়ছে। যারা আগে নিয়মিত ফার্নিচার কিনতেন, তারা হয়তো এখন কেনা বন্ধ করেছেন বা কমিয়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন : বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফার্নিচার শিল্পের প্রভাব কেমন?
উত্তর : আসবাব খাতের সংযোগ শিল্পগুলো পর্যাপ্তভাবে গড়ে না ওঠায় বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং ফিনিশিংয়ের জন্য ব্যবহৃত লেকারসহ অনেক উপকরণও আমদানি করতে হয়। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এসব কাঁচামাল আমদানিতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে, যার ফলে উদ্যোক্তারা বাধ্য হয়ে আসবাবের দামও বাড়িয়েছেন। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খোলার প্রক্রিয়ায়ও বিলম্ব হচ্ছে, যা কাঁচামালের আমদানিতে জটিলতা তৈরি করছে।
প্রশ্ন : ফার্নিচার শিল্পে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো আরও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করা। আমরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নান্দনিক নকশা ও উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জাতীয় অগ্রগতিতে আর্থিক অবদান রাখতে চাই। একইসঙ্গে আমরা দেশের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অবদান অব্যাহত রাখতে চাই।