বাইফোকাল লেন্স
সম্পর্কোন্নয়নে ভারতকেই আগে তাদের নীতি বদলাতে হবে

একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র, অতএব তাদের ঠিক করতে হবে, তারা কী ধরনের সম্পর্ক আমাদের সঙ্গে রাখতে চায়।’ তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দু-একজন উপদেষ্টার ভারত সম্পর্কিত কিছু বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ভালো সম্পর্ক রক্ষার কথা বলে যদি সব বিষয়ে ভারতকে দোষারোপ করা হয়, তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে না।’ বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আচরণের বিষয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা অবশ্যই আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আমাদের বলা ‘উচিত’ এবং আমরা বলেওছি।’’ ‘জয়শঙ্করের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে। অবশেষে জয়শঙ্করের বক্তব্যের দুদিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন পালটা জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান ঠিক করবে। একই সময়ে ভারতকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। এটি পারস্পরিক বিষয়। আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত। আমরা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে একটি ভালো কার্যকর সম্পর্ক চাই। আমাদের অবস্থানে কোনো দোদুল্যমানতা নেই।’
ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্নজনের বিভিন্ন বক্তব্য ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে জয়শঙ্করের মন্তব্যের যথাযথ জবাবও দিয়েছেন তৌহিদ হোসেন। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। এ পরিস্থিতি ভারতীয় মিডিয়ার তৈরি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন,‘তারা যে তথ্যপ্রভাব সৃষ্টি করেছে, তার ভিত্তিতে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে কথা বলছেন। এ রকম কথা আমাদের এখান থেকে যেমন বলছে, ভারতের তরফ থেকেও অনুরূপ কথা বলা হচ্ছে। ওনাদের একজন মুখ্যমন্ত্রী তো পারলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের ফোর্স পাঠিয়ে দেন। ভারতের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অহরহ বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই এগুলো চলতে থাকবে ধরে নিয়েই আমরা চেষ্টা করছি, সম্পর্ক ভালো করা যায় কিনা। আমাদের অবস্থান সেটাই।’ তারপর সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ভারতের বিষয় হতে পারে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাংলাদেশের বিষয়। ভারতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হচ্ছে, সেটা আবার তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। অতএব, আমাদের একে অপরের বিষয়ে নাক গলানো উচিত না।’
ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে এত মাথা না ঘামিয়ে তার কিয়দংশও যদি নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি নজর দিত, তাহলে হয়তো প্রতি বছর সংখ্যালঘু হত্যার সংখ্যা আরও কিছু কম হতে পারত। নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে যেখানে অনেক অভিযোগ, সেখানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কতটুকু যুক্তিসংগত, সে প্রশ্ন আসতেই পারে। গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সে দেশে সংখ্যালঘু; বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে সে দেশে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ইলেকট্রিক পাইলনে বেঁধে সবার সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখন দোষীরা যেভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে, সেটাই আসলে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ভারতে মানুষে-মানুষে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, যা ভারতে আগে কখনো দেখা যায়নি; এখন প্রতিনিয়ত এ ধরনের উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনায় ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে আশ্চর্য হতে হয়। অবাক কাণ্ড হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এসব ঘটনায় হয় নীরব থাকছেন, নয়তো দায়সারা জবাব দিচ্ছেন। এ অভিযোগ শুধু নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের নয়, সে দেশের মুক্তবুদ্ধির সচেতন নাগরিকদেরও।
ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলিমদের টার্গেট করে নির্যাতন চালানো হয়। মুসলিমদের প্রতি শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডই নয়, খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে মুসলিমদের মসজিদ ধ্বংসেরও প্রচেষ্টায় জারি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা সে দেশের আদালতকে ব্যবহার করছে। ১৯৯২ সালে ষোড়শ শতকের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে বিতর্ক যাতে না হয়, সেজন্য ভারত সরকার প্লেসেস অব ওরশিপ (স্পেশাল প্রোভিশনস) অ্যাক্ট নামে একটি আইন পাস করেছিল, যেখানে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বিদ্যমান থাকা কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ের চরিত্র বদলানো যাবে না এবং এ বিষয়ে কোনো মামলাও করা যাবে না। তবে বাবরি মসজিদকে এ আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল, যা বিতর্কিত এক সিদ্ধান্ত ছিল। এ আইনের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না। ২০২২ সালে বারানসির আদালত, ওই আইনকে উপেক্ষা করে ‘জ্ঞানবাপি মসজিদ’-এর ভিডিও জরিপের অনুমতি দিয়েছেন। এরপর থেকেই ভারতের বিভিন্ন মসজিদের নিচে মন্দির আছে দাবি করে একই ধরনের নতুন মামলার ঢল নামে। অতঃপর এ ধরনের জরিপ কাজকে কেন্দ্র করে ভারতে মুসলিম হত্যার ঘটনাও শুরু হয়ে যায়। এরূপ সর্বশেষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত নভেম্বরে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের সামভালে মোগল আমলের একটি মসজিদ যেখানে তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আগে মন্দির ছিল-এমন দাবি করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী। ২৩ নভেম্বর সকালে একটি দল যখন জরিপ চালাতে যায়, তখন সেখানকার মুসল্লিরা বাধা দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পুলিশ গুলি করে নাঈম, বিলাল ও নোমান নামের তিন মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সে দলের সমর্থকদের হাতে মুসলিমরা যে হরহামেশাই নিগৃহীত হচ্ছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হচ্ছেন, সে বিষয়ে তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। যে মুসলিমদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের কি ভারতের জন্য কোনো অবদানই নেই? এ কথা কি অস্বীকার করা যায়, মুসলিমদের রক্তেই লিখিত হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস? জনসংখ্যার অনুপাতে বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা কম হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে যে ৯৫ হাজার ৩০০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম লেখা আছে, তার মধ্যে ৬১ হাজার ৯৪৫ জনই হলেন মুসলিম; অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন মুসলিম। মুসলিমরা বর্তমানেও কি নিজের ঘাম ও রক্ত ঝরিয়ে ভারতের উন্নয়নে কোনো অবদানই রাখছে না? অথচ ভারতজুড়ে সেই মুসলিমদের সঙ্গেই কী নির্মম আচরণ করা হচ্ছে! অতএব, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং ভারতের মুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা কীভাবে দেওয়া যায়, সে কথাই জয়শঙ্করের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবা উচিত।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যার কথা বলা হয়েছে। একই রিপোর্টে, এ হত্যাকাণ্ডের সরাসরি হুকুমদাতা হিসাবে শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করেছে। এতগুলো হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে এখন যদি সুসম্পর্ক স্থাপনের কথা বলে, তাতে ভারতের আন্তরিকতা কতটুকু প্রকাশ পায়, সে প্রশ্নও রয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বাংলাদেশ অনেক আগেই ভারতের কাছে অনুরোধ করে পত্র পাঠিয়েছে। ভারত এযাবৎ সেই অনুরোধের কোনো জবাব না দিয়ে যে অসৌজন্যমূলক মনোভাব দেখাচ্ছে, তা কি সুসম্পর্কের জন্য অন্তরায় নয়? ভারত যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে নাই চায়, তাহলে এ বিষয়টি ঝুলিয়ে না রেখে, দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির কোন ধারা অনুযায়ী পাঠাতে পারবে না উল্লেখ করে, এতদিনে তা বাংলাদেশকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ভারত শেখ হাসিনাকে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, ওই দেশে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগও করে দিচ্ছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, ‘সম্পর্ক ভালো করতে গেলে বরং আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যে ওখানে ভারতীয় আতিথেয়তায় থেকে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছেন, এগুলো আসলে সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। ওনার বক্তব্য আগুনে ঘি ঢালছে, এটা তো স্বীকৃত ব্যাপার, এটা সবাই জানে।’ অর্থাৎ এটা ভারতও জানে। ভারত জেনেশুনেই এ কাজটি করে যাচ্ছে।
আসলে জয়শঙ্করের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতবিদ্বেষী বক্তব্য কিংবা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমস্যা বড় কোনো ইস্যু নয়; শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে না চাইতেই তারা যা পেয়েছে, (শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী) তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাগতিকে মনে হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অথবা অদূরভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা শেখ হাসিনার মতো ভারতের প্রত্যাশা যদি পূরণ করতে পারে, তাহলেই খুশি। তবে ভারতকে মনে রাখতে হবে, নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই যে কর্ম করে গেছেন, আগামীতে তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশিরা সংগ্রামী এক জাতি। জীবনবাজি রেখে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আত্মসম্মানের বিনিময়ে কারও সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক নয়; বরং সমমর্যাদার সম্পর্কে বিশ্বাসী। কাজেই ভারতকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। এ পর্যায়ে সিনিয়র এক সাংবাদিকের মন্তব্যের উল্লেখ করে লেখাটির সমাপ্তি টানতে চাই। ‘এদেশে নজিরবিহীন স্বৈরাচার কায়েমে প্রকাশ্যে যে ভারত সহায়তা জুগিয়েছে, সেই ভারতকেই আগে তাদের নীতি বদলাতে হবে এবং সেটা স্পষ্ট হতে হবে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তার অবস্থান বদলে ফেলেছে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

