Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভারতকে এ দেশের মানুষের আত্মমর্যাদাবোধকে সম্মান করতে হবে

Icon

এম. হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতকে এ দেশের মানুষের আত্মমর্যাদাবোধকে সম্মান করতে হবে

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার তৎপরতাকে ভালোভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ব্যবস্থাপনাটা কীভাবে হবে, তা নিয়ে ১৯৭৫ সালেই দুদেশের মধ্যে ‘বর্ডার গাইডলাইনস’ বলে একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা আছে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা আছে, সীমান্তরেখার ১৫০ গজের মধ্যে কোনো দিকেই কেউ এমন কোনো স্থাপনা করবে না, যাতে সীমান্তের এ অঞ্চলটার নিরাপত্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কাজেই তারা ২০১০ সালের যে এগ্রিমেন্টের কথা বলছে, তাতে সীমান্তের ওপর বেড়া বা কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কোনো অধিকার দেওয়া হয়েছে কিনা, তা আমার জানা নেই। আমি জানি যে, দুদেশের মধ্যে ১৯৭৫ সালের বর্ডার গাইডলাইনস অনুযায়ী সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কাজটা সম্পন্ন হয়। এখন দুটো জিনিস আমার কাছে মনে হয়েছে। একটা হচ্ছে, ভারতের দিক থেকে সরকারি পর্যায় থেকে এটি নতুন করে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি বা জটিলতা তৈরির একটা প্রয়াস বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ তারাও জানে, সীমান্তে বেড়া দিতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিবাদ করবে এবং যেটি ইতোমধ্যে করাও হয়েছে, যে কারণে তা থামল এ মুহূর্তে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এমনিতেই আমরা জানি যে, বাংলাদেশে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে ৫ আগস্ট এবং এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা নতুন জাগরণ, আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটটা ভারতের জন্য আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন। এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাটা ধরেই দুদেশের মধ্যে সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে হবে।

সীমান্তকে কেন্দ্র করে দুদেশের সম্পর্কের যে টানাপোড়েনটা দেখছি আমরা, সেটা দুই দিকের বৃহত্তর বোঝাপড়ার ঘাটতির জায়গাটাই কিন্তু স্পষ্ট করে তুলছে। কারণ গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে, এটা যে কোনো জাতির জন্যই হতে পারে এবং আমাদের জন্য তা ইতিবাচক বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি। এখন ভারত আমার নিকট প্রতিবেশী হিসাবে যেহেতু তার সঙ্গে আমার বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে, তাকে কিন্তু এ পরিবর্তনটা উপলব্ধি করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত ভারতের দিক থেকে এ উপলব্ধির জায়গাটা সঠিকভাবে অনুভূত হচ্ছে না। ভারতের দিক থেকেও কিন্তু বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, অতিরঞ্জন প্রচারণার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। সেটা ভারত সরকারের একটি অংশ থেকে হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের দিক থেকে সেটা হচ্ছে, মিডিয়া জগতে হচ্ছে, জনগণের পর্যায়ে হচ্ছে এবং এখানে যেটি বিপজ্জনক বিষয়, সেটা হচ্ছে আগে পররাষ্ট্রনীতি বা সম্পর্কের বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে অথবা যারা সম্পৃক্ত আছেন, তাদের পর্যায়ে এটা সম্পন্ন হতো; এখন কিন্তু দুদেশের জনগণের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেল, যেটা আমরা সম্প্রতি বর্ডারে দেখলাম।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসার সুযোগ তো রয়েছেই। সীমান্ত সম্পর্কে যে কোনো চুক্তিতেই একটা প্রভিশন থাকে অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এটা সংশোধন কিংবা বাতিলের সুযোগ থাকে। কাজেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তিগুলো আছে, সেখানে এ বিষয়টা আছে বলে আমি ধরে নিচ্ছি। তো সেই প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের দিক থেকে যখন আমরা মনে করছি ভারতের কোনো একটা অবস্থান সঠিক নয় এবং তারা যদি সেখানে কোনো দলিলের ভিত্তিতে বা চুক্তির ভিত্তিতে বক্তব্য দিতে আসে, আমরা নিশ্চয়ই সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব করতে পারি। আমার ধারণা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সে বিষয়টা উল্লেখ করেছেন এবং তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, আগামী মাসে বিজিবি এবং বিএসএফ আলোচনায় বসবে, তখন এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। আমি মনে করি, এখন যে সীমান্তের ওপরে বেড়া দেওয়া হচ্ছে, এতে করে জটিলতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হবে না। এছাড়া বড় যে প্রশ্নটি রয়েছে, তা হলো, আপনি যদি আমাকে বন্ধু দেশ বলে মনে করেন বা আমার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চান, তাহলে আপনি আমার ঘরের সামনে এসে কাঁটাতারের বেড়া দিলে কি তা সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে, না বিপক্ষে যাবে? এটা তাদেরও উপলব্ধি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

এখানে সীমান্ত অঞ্চলে একটা পারস্পরিকতা আছে। যেমন ভারতের দিক থেকে আগরতলা বলুন কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলুন, সেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ যাতায়াত না করার কারণে, সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে না চলার কারণে। কাজেই আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন একে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে দুই দেশের চলাচলের সুযোগটা তৈরি করতে হবে অর্থাৎ ভিসা প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করতে হবে। এটি যদি স্বাভাবিক না হয় এবং আপনি যদি বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার কখন আসবে, এজন্য অপেক্ষা করতে চান, তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য এলে আমি মনে করি, তা সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে না। আপনি যখন এ কথাটা বলছেন, তার মানে হচ্ছে, আপনি পরোক্ষভাবে বলে দিচ্ছেন, এখন যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে আগ্রহী নই। আমার মনে হয় এ জায়গাটায় আরেকটু স্বাভাবিক চিন্তার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আমাদের জায়গা থেকে কয়েকদিন আগেই পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়ে গেল, আমাদের দিক থেকে যে বক্তব্য দেওয়া দরকার, সেগুলো আমরা বলেছি। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, আমরা আত্মমর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্কটা চাই। এটা হচ্ছে তাত্ত্বিক কথা আর বাস্তব অর্থে বলতে গেলে, ভিসা প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক করা প্রয়োজন, দুদেশের মধ্যে যোগাযোগটা স্বাভাবিক করা দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রক্রিয়াটা যাতে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে, এজন্য তাদের পক্ষ থেকেই মূল উদ্যোগটা নেওয়া দরকার, আমরাও সেটাকে স্বাগত জানাব।

এম. হুমায়ুন কবির : প্রাবন্ধিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম