Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

ওয়াকারের মুকুটে আরেকটি পালক

মারুফ কামাল খান

মারুফ কামাল খান

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম

ওয়াকারের মুকুটে আরেকটি পালক

অনেক দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ঢাকনা খুলে গেলে একটু উথাল-পাতাল বেশিই হয়। এটা স্বাভাবিক। ষোলো-সতেরো বছর বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা অবাধ ছিল না। হাসিনা রেজিম তাদের বজ্রআঁটুনির গিঁট শক্ত করতে করতে শেষ অব্দি এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করেছিল। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমালোচনা দূরে থাক, মন খুলে কথা বলাও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তারপর ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে ওরা কুপোকাত হলো। প্রায় সবাই গণরোষের হাত থেকে নিস্তার পেতে পালিয়ে বাঁচলো। সব বন্ধ কপাট হাট করে খুলে গেলো। এলো মুক্তি, অবারিত হলো স্বাধীনতা।

এখন যখন যার খুশি সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী তো দমে দমে ধোলাই করে ছাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়া তো এখন বেড়াছাড়া খোলা ছাপড়া ঘরের আড্ডা। সেখানে হরদম উঠছে চায়ের কাপে ঝড়। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স হ্যান্ডেলে লক্ষ্যভেদী ও লক্ষ্যহীন, মতলবি ও এলোপাতাড়ি অ্যাক্টিভিজম সব সীমানা ছাড়িয়ে মাঝেমধ্যে বিপজ্জনকও হয়ে উঠছে। যে রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিস্ট রেজিমে আক্রান্ত হয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে অস্তিত্ব রক্ষায় যৎসামান্য প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে তারাও আর ভাই-ভাই নাই, ঠাঁই-ঠাঁই হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে কথার ছুরি শাণাচ্ছে। একজনে ঢিল ছুঁড়লে আরেকজনে মেরে দিচ্ছে পাটকেল।

সশস্ত্রবাহিনী ছিল সব সময়েই একটা পরম স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। এখন তাদেরকেও ধুয়ে দিচ্ছে। সেনাপ্রধানও ন্যায়-অন্যায় হরেক রকম নিন্দা ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বৈবাহিক সূত্রে পতিত ফ্যাসিস্ট রেজিমপ্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয়। হয়তো আত্মীয় বলেই হাসিনা তাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে, তার নিয়োজিত আগেকার সেনাপ্রধানদের চাইতেও আরো বেশি করে অবৈধ স্বেচ্ছাচারী শাসনকে সব দিক থেকে সুরক্ষা দেবেন জেনারেল ওয়াকার। তবে বিধি বাম হাসিনার, শেষ অব্দি তা' হয়নি। দেশে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে হাসিনা আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন নামের গুণ্ডাদের নামিয়েছিলেন। ছাত্র-যুব-স্বেচ্ছাসেবক-মহিলা নামাঙ্কিত সেই সব লীগ পাণ্ডারা সর্বশক্তি নিয়ে পুলিশের ছত্রছায়ায় দমন অভিযানে নেমেও সন্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ওরা পরাজিত হলে হাসিনা রাষ্ট্রীয় যে-সব বাহিনীকে তার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত করে যেমন খুশি তেমন অপব্যবহার করেছেন তাদেরকে মাঠে নামান। পুলিস, র্যাব, আনসার, বিজিবি প্রভৃতি বাহিনী রণহুংকার দিয়ে মাঠে নামে। বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে পাখির মতো তারা হত্যা করতে থাকে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানদের। এই হত্যাযজ্ঞ দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। তারা তাদের সন্তানদের রক্ষায় মাঠে নামে। জনতার রুদ্ররোষের অনল জ্বলে ওঠে সবখানে। মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে বুলেট-বৃষ্টির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া তরুণদের কে রুখতে পারে? তাদের দুর্জয় প্রতিরোধে হেরে যায় ঘাতক বাহিনী।

এরপর শেষ ব্রহ্মাস্ত্র হেনে হাসিনা তার মসনদ রক্ষায় তৎপর হন। কার্ফ্যু জারি ও ইন্টারনেট যোগাযোগ ছিন্ন, মিডিয়ায় সব ঘটনা ব্ল্যাকআউট করে, দেখামাত্র গুলির হুকুম দিয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে নামানো হয়। কিন্তু দেশরক্ষার সৈনিকদের বড় অংশ এই অন্যায় ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের অংশীদার হতে অস্বীকার করে। সেনাপ্রধান ওয়াকার সেই অস্বীকৃতির বার্তা হাসিনাকে জানিয়ে দিলে তার সব খেল খতম হয়ে যায়। সময়সীমা বেঁধে দিয়ে হাসিনাকে অবিলম্বে দেশত্যাগ করতে বলা হয়। জানিয়ে দেওয়া হয়, এছাড়া তাকে নিরাপত্তা দিতে কিংবা তার প্রাণরক্ষা করতে গেলে বিপুল রক্তপাত ঘটবে। সে দায়িত্ব সশস্ত্রবাহিনী নিতে পারবে না। হাসিনাকে এ নির্দেশ বাধ্য হয়ে মান্য করতে হয়। তার ফ্যাসিস্ট রেজিমের অবসান ঘটে।

শুধু তাই নয়, বিচারক, পুলিশ, সরকারি কর্মচারী, সংসদের কর্তা, আওয়ামী রাজনীতিকসহ ৬ শতাধিক লোককে সেনাছাউনিতে আশ্রয় দিতে জনরোষে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার দায়িত্বও সশস্ত্র বাহিনী পালন করে এবং তাদের জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে সে তথ্য দেশবাসীকে জানায়। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সেনাপ্রধান দেশাত্মবোধক একটি নৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে  নিজেকে রক্ষা করেছেন, সেনাবাহিনীকে রক্ষা করেছেন, যুধ্যমান দু'টি পক্ষের অনেকের জীবন রক্ষা করেছেন এবং বিপর্যয়কর একটি রক্তপাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। ক্রান্তিকালে এভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষাই তো সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান কর্তব্য। নৌ ও বিমান বাহিনীও সেনাবাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। তারা সকলেই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।

স্বৈরাচারের পরিত্যক্ত এক বিপর্যস্ত শাসনব্যবস্থাকে ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এখনো বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী পালন করে চলেছে সক্রিয় ভূমিকা। তবুও নানামুখি প্রচারণায় তাদেরকে ঘায়েল করা ও সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করার অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। জাতীয় নিরাপত্তার ও সংহতির প্রতীক হিসেবে সশস্ত্রবাহিনীর এখনকার ভূমিকা অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্রান্তিকালে তাদেরকে বাইরের আঘাত ও ভেতরকার কুইসলিংদের অপতৎপরতাও দু'হাতে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের ব্যাপারে জনআস্থায় চিড় ধরানোর যে-কোনো অপপ্রয়াস মূলতঃ জাতির দুশমনদের স্বার্থই রক্ষা করবে। সমালোচনার ঊর্ধে কেউ নন। সমালোচনা হতেই পারে। তবে সমালোচনা করতে গিয়ে যেন কুৎসা রটনা করে ফেলা না হয়। সমালোচনার ভাষা ও ভঙ্গি যেন হয় শোধনমূলক, ধ্বংসাত্মক যেন না হয়। প্রচারিত তথ্য যেন ভুল, বিকৃত ও কষ্টকল্পিত না হয়। 

এরমধ্যে সেনাপ্রধান ওয়াকার সস্ত্রীক বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন তার গুলশানের ভাড়া বাসায় গিয়ে। আগামী ৭ জানুয়ারি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার্থে বেগম জিয়ার দেশ ছাড়ার কথা। জেনারেল ওয়াকার ম্যাডাম জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থার খোঁজখবর নেন। তিনি তার জন্য দোয়া করেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, "আপনি সুস্থ হয়ে দ্রুত ফিরে আসবেন এবং আগামীতে আমি আপনার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দিক-নির্দেশনা পাবো।" জেনারেল ওয়াকার ও সারাহনাজ কমলিকা দম্পতি কয়েক যুগ আগে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বেগম জিয়ার যোগদানের কথাও স্মরণ করেন।

এই সাক্ষাতের মাধ্যমে সেনাপ্রধান এক পরম সৌজন্য ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এর আগে সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষেও তিনি ম্যাডাম জিয়ার প্রতি যথেষ্ট মর্যাদা প্রদর্শন করেছেন। সেটা ছিল আনুষ্ঠানিক। আর এবারকার সাক্ষাৎ পর্বটি অনানুষ্ঠানিক। এর মধ্যে ব্যক্তিগত সৌজন্য ও বিনয়ের পাশাপাশি দেশ, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্রবাহিনীর অবস্থানেরও ব্যাপারও কিন্তু জড়িয়ে আছে।

সবার মন সমান পরিষ্কার নয়। নষ্ট মনের লোকেরা এ নিয়ে নানান সন্দেহ, সংশয় ছড়াচ্ছে ও কুমতলব খোঁজার চেষ্টা করছে। ভারতীয় মিডিয়াও তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বর্ডার ক্রস করে এ নিয়ে নাক গলিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে একজন রাজনৈতিক নেত্রীর সঙ্গে সেনাপ্রধানের এ নজিরবিহীন সাক্ষাৎ কেন?

প্রথম কথা, ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন থেকে অসম্মানজনক উচ্ছেদসহ বেগম জিয়া বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনাকালে যত অন্যায়ের শিকার হয়েছেন তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সেনাবাহিনীর জন্য এক কলঙ্কের ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে। জেনারেল ওয়াকার বেগম জিয়ার প্রতি বাড়তি সম্মান প্রদর্শন করে সেই কলঙ্ক মোছার চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি তার বাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।

দ্বিতীয় কথা, বেগম জিয়াকে আমি অন্তত. এখন নিছক কোনো রাজনীতিবিদ বা দলীয় প্রধান মনে করি না। তিনি কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন ফার্স্টলেডি, এককালের সেনাপ্রধানের স্ত্রী কিংবা সেনাপরিবারের একজন সদস্য বা অবিভাবকমাত্র নন। সব মিলিয়ে তিনি আরো অনেক বড় কিছু। বিএনপির প্রকৃত প্রধান এখন তারেক রহমান, খালেদা জিয়া নন। বেগম জিয়া এসবের অনেক উর্ধে উঠে গেছেন। তিনি দেশের সবচে' জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি জাতীয় ঐক্য এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীকি ব্যক্তিত্ব বা আইকনে পরিণত হয়েছেন। সেনাবাহিনীকে পুনরায় জনঘনিষ্ঠ করতে হলে বেগম জিয়ার সান্নিধ্য ও সমর্থন প্রয়োজন। ইতিহাসের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উত্তাল ঘটনাপ্রবাহ পেরুনো অভিজ্ঞতাপ্রসূত তার নির্দেশনা এখনকার সেনানেতৃত্বের জন্য বাস্তবিকই প্রয়োজন। জেনারেল ওয়াকার সেটা জেনে বুঝেই গেছেন এবং সঠিক কাজটিই করেছেন। এই প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তে তার সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পালক।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

ই-মেইল: mrfshl@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম