শিক্ষা সমাজ দেশ
দেশ সংস্কারে যা করা যেতে পারে
ড. হাসনান আহমেদ
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে সংস্কার মৌসুম চলছে। বিগত সরকার পতনের আগে ও পরে দেশ সংস্কার নিয়ে অনেকবারই কলামে লিখেছি। আগের লেখাগুলো পতিত সরকার গুরুত্ব দেয়নি। পরে তিন-চারটি লেখায় বেশকিছু সংস্কারভাবনা দলনিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেছি। একই কথা অবশ্য বারবার লিখতেও খারাপ লাগে। যদিও একটাই লক্ষ্য, লক্ষ্যভ্রষ্ট দেশের কীভাবে কল্যাণ করা যায়। বর্তমানে এ দেশের আইন ও নিয়মনীতিতে সংস্কারের তোড়জোড় দেখে আরও কিছু কথা লেখার প্রয়াস অব্যাহত রাখছি। এগুলোকে বারোয়ারি বয়ান বলা যায়। জানি না, এসব কথা হালে পানি পাবে কিনা। একটা কথা আগে বলে রাখি: বিগত ১৬ বছরে রাজনীতিকদের সীমাহীন দুষ্কর্মে মনের গভীরে ঘৃণায় দগদগে ঘা সৃষ্টি হয়েছে, যা মলম-মালিশে নিশ্চয়ই যাবে না। সদ্য পতিত রাজনীতিকরা নিজেরা লুটেপুটে খেয়েছে, আবার সাধারণ জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে রেখে গেছে, যা এত সহজে মেরামতযোগ্য নয়। এতে নীতি-আদর্শহীন সামাজিক টাউটদের পোয়াবারো হয়েছে। এখনো সমাজের পরতে পরতে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সেসব চোরচোট্টা ও বিবেকবোধরহিতরা ধর্মের কাহিনি শুনবে না, বরং জীবনযাত্রাকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, দেশকে আরও ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে।
সাধারণভাবে অতি বুদ্ধিমান এদের দুভাবে ভাগ করা যায়-মানুষ ও অমানুষ। মনুষ্যত্বের গুণাবলি যাদের মধ্যে বেশি, তাদের মানুষ বলা যায়। অমানুষ দেখতে মানুষের মতো হলেও তারা বর্বর দলভুক্ত। আভিধানিক অর্থে অমানুষ বলতে যাদের মনুষ্যত্ববর্জিত, পশুতুল্য মানুষ বোঝায়; আমার দৃষ্টিতে এদের ‘নরাধম’ বলা যায়। এরা মানুষ নামের কলঙ্ক, স্বদেশবিরোধী, পরিচ্ছন্দানুবর্তী। ভাবতে কষ্ট লাগে, ১৬ বছর যারা আধিপত্যবাদী প্রভুর সহায়তায় গুরু-চেলা মিলে বিরোধী দলগুলো নির্মূলের উদ্দেশ্যে যথেচ্ছ দমন-পীড়ন-নির্যাতন, গুম-হত্যা, ডাহা মিথ্যাচারিতা করল, হাজার হাজার ছাত্র-জনতার বুকে নির্দ্বিধায় গুলি চালাল, সাধারণ মানুষের অর্থকড়ি, ব্যাংক লুটপাট, বেপরোয়া আত্মসাৎ ও সর্বস্ব বিদেশে পাচার করে দেশবাসীকে আকণ্ঠ ঋণের ভারে ডুবিয়ে কোষাগার চেটেপুটে বিদেশে পালাল; তাদের মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা ও অপরাবোধ কাজ করে না। অমানুষের কোন্ নিম্নপর্যায়ে পৌঁছলে তারা নিজেদের এখনো মানুষ বলে দাবি করতে পারে? এদের সংখ্যা এ দেশে নেহাত কম নয়। এজন্যই দেশ মেরামত এত সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
অনেকে দুর্নীতি-গণহত্যা করেছে, আবার অনেকে তাদের দেখে শিখেছে। তাই আমার প্রথম প্রস্তাব হলো-রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংস্কার আগে না করা হলে, অন্য আইন সংস্কারে তেমন ফলোদয় কিছু হবে না। ক্যানসার চিকিৎসায় রোগী বাঁচাতে গেলে ডাক্তারকে কষ্টদায়ক কেমোথেরাপি প্রয়োগ তো করতেই হয়। আইন থাকে বইয়ের পাতায়, তাকে বাস্তবায়ন না করলে আইন তো নিজে বাস্তবায়িত হয় না। এ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল এ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপ দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি; যদিও দেশ গড়ার প্রি-রিকুইজিট হলো জনগোষ্ঠীকে চাহিদামতো জনসম্পদে পরিণত করা। তাছাড়া সংস্কার কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সন্তুষ্টির জন্য না করে এ দেশের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব, উন্নতি ও জনসাধারণের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে করতে হবে। এতে কোন দল কী ভাবল, এটা দেখার সময় এখন নেই, সেজন্যই নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারকে কোমরে জোর বেঁধে কাজে নামতে হবে। সবার স্বার্থরক্ষা করে কাজ করা কঠিন। যে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস শক্ত হাতে দমন করতে হবে। কাউকে বা কোনো মতলববাজ গোষ্ঠীকে কোনোরকম ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। জনগোষ্ঠী সুশিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত, সব পর্যায়ে অবাধ গণতন্ত্র না দেওয়াই শ্রেয়।
আগের লেখায় রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনে আমার প্রস্তাব ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। দেশ চালাবে রাজনৈতিক দলীয় সরকার; রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেখভালের জন্য এবং বিভিন্ন বিভাগে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য ১৫ থেকে ২১ সদস্যের অরাজনৈতিক ‘সুপ্রিম কাউন্সিল’ থাকবে, যারা নির্ধারিত অরাজনৈতিক পেশাজীবী নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। এতে বর্তমানে সমমনোভাবাপন্ন দলীয়ভাবে মনোনীত রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা লোপ পাবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শুধু একটা নির্বাচন করে দায়িত্ব হস্তান্তর করাই এ সরকারের জন্য যথেষ্ট নয়। কালবোশেখির প্রচণ্ড ঝড়ে লাইনচ্যুত হওয়া একটা ট্রেনকে লাইনে এনে গন্তব্যে পৌঁছানোর সামগ্রিক ব্যবস্থা ঠিকঠাক মতো করাই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল। আমরা যেন কোনোমতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে না যাই। এখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। আমার দৃষ্টিতে এ বিপ্লব এখনো শেষ হয়ে যায়নি, উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে মাত্র। ছাত্র-জনতাকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে আমরা পারছি না। বিপ্লবের ভাষা কঠিন; এখানে উদারতার কোনো স্থান নেই। উপদেষ্টাদেরও সেই শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে অথবা কেউ কেউ অপারগতা দেখালে পদ ছাড়তে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এত অল্পে পরাভব মানা ঠিক হবে না। ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন কার্ড’ নামে মতলববাজি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা শক্ত হাতে দমন করা এখনই দরকার। দীর্ঘ ১৬ বছর তাদের দাবি-দাওয়া কোথায় ছিল?
দেশপ্রেমী সব রাজনৈতিক দলকে এখন ধৈর্য ধরতেই হবে। বুঝতে হবে প্রতারণা, স্বার্থপরতা ও ‘কর্তাভজা সম্প্রদায়’-এর কারণে স্বাধীনতার কমপক্ষে চল্লিশ বছরের অনেক মূল্যবান সময়ই পার হয়ে গেছে; স্বাধীনতার উদ্দেশ্যের কিছুই অর্জিত হয়নি। এ চৈতন্যবোধ দেশপ্রেমী বাংলাদেশিদের যত তাড়াতাড়ি ফেরে, ততই দেশের কল্যাণ। দেশ ও মানুষ গড়তে দুটো বিষয় অপরিহার্য জানতে হবে-দেশকে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড় করানো ও জনগোষ্ঠীকে সুশিক্ষিত করা। যাহোক আজ কয়েকটা প্রস্তাব রাখি। সরকারের মেয়াদ চার বছর না করে পাঁচ বছর রাখাই সমীচীন হবে। ঘন ঘন নির্বাচনে খরচ বাড়ে। নির্বাচিত সরকার উন্নয়নের কিছু কাজ করতে না করতেই মেয়াদ শেষ হবে। বাংলাদেশিরা রাজনীতিপাগল হয়ে গেছে। কারণ রাজনীতি এ দেশে বিনাপুঁজির লাভজনক ব্যবসা। কোনো জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা নেই। এদের মধ্যে কীভাবে জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা যায়, তা ভাবা দরকার। সেজন্য চাই সংস্কার। বর্তমানে রাজনীতিতে দেশশোষণ আছে-নেই সমাজসেবা ও জনসেবা; শুধুই মিথ্যাচার, ধাপ্পাবাজি, রাজনীতির ব্যবসা আর প্রতারণার কৌশল। মানুষকে রাজনীতিমুখিতা থেকে ফিরিয়ে কর্মমুখী ও সমাজসেবামুখী করতে হবে। এরও উপায় ও মডেল আছে। বিকৃতমনা মুখসর্বস্ব লাঠিয়াল বাহিনীর দখলিস্বত্বে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানুষের এদেশে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের কথা শুনছি। এর অনেক দূরদর্শী প্রভাব আছে। স্থানীয় সরকারে দলভিত্তিক নির্বাচন হওয়ায় সমাজে বিভক্তি, দলাদলি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ, দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব বহুলাংশে বেড়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে আইনের শাসন নেই বললেই চলে। মুখ ও দল বিবেচনায় সালিশ-দরবার হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সালিশের নামে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে খাচ্ছে। বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই রক্ষা করে কেন্দ্রীয় নেতারা। সমাজে দলীয় স্বজনপ্রীতি বেড়ে গেছে। সামাজিক সুশিক্ষা নির্বাসনে। সরকার থেকে গম, টাকা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি নামে যত আর্থিক সুবিধা যায়, নিজ দলীয় লোকজনের মধ্যেই বণ্টন হতে দেখা যায়, বিরোধী ও সাধারণ লোকজনের কপাল পোড়ে। রাজনীতির দাপটে কেউ কিছু বলেও না। সমাজকে সুস্থ বানাতে বা সমতার নীতি বহাল রাখতে স্থানীয় সরকারে অরাজনৈতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিকৃত রাজনীতির চর্চা সমাজে কমে যাবে। বিকৃত ও মতলববাজি রাজনীতির কারণে দেশ, সমাজ ও শিক্ষা যে ধ্বংস হয়ে গেল, এটি আমরা কেউ ভেবে দেখিনে। দেশে সব সমস্যার মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি।
এদেশে দেশপ্রেমী দূরদর্শী রাজনীতিবিদের বড় অভাব। কে কোন দল করে, এটাই তাদের মূল বিবেচ্য বিষয়। দেশকে অন্যায়, দুর্নীতি ও অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া যত সহজ, ভালো পথে ফিরিয়ে আনা তত সহজ নয়, এ ভাবনা তাদের মাথায় নেই। শুধু গণতন্ত্র নয়; সমাজে বসবাসরত মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সমাজে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে, সামাজিক শিক্ষা ত্বরান্বিত করতে হবে। তা না হলে যত চেষ্টাই করা হোক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান বাড়বে না। গবেষণায় দেখা যায়, এ দুটো চলকের মধ্যে ধনাত্মক সহ-সম্বন্ধ রয়েছে।
পনেরো বছর ধরে যেসব সরকারি বিভাগগুলোকে দলীয় নিজস্ব লোকবল দিয়ে সাজানো হয়েছে, এত অল্প দিনে নিখাদ কর্মঠ অফিসার খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রায় সবাই দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, বাকিরা চাকরিচ্যুত বা ওএসডি হয়ে বসে আছেন। সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তা, কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা হতে পারে না। সেজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী আচরণবিধি পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে ভালো পথে নিয়ে আসাটা অনেক কষ্টকর বিষয়। রাষ্ট্রপরিচালনা (সুপ্রিম কাউন্সিলের মাধ্যমে) সরকার পরিচালনা থেকে আলাদা করে রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য এনে, বিভিন্ন বিভাগ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করলে, নিশ্চয়ই ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে ‘অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চড়চড় করে’ কথাটা ভুললে চলবে না। এদেশে ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতে সংসদে আসন বণ্টন বিষয়টি বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথও তখন থাকবে না। সেজন্য মনে হয়, প্রবাদটা এভাবে এসেছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।
অধ্যাপক ড. হাসনান আহমেদ এফসিএমএ : সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ
Web: pathorekhahasnan.com