সিপিডির সেমিনারে বাণিজ্য উপদেষ্টা
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অর্থ পাচারে বড় ক্ষতি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিগত সময়ে দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল। বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অর্থপাচার দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এছাড়াও দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে ব্যাংকিং খাতসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণে। সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত দুদিনব্যাপী সেমিনার উদ্বোধন করে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এসব কথা বলেন। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস বিষয়ে টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ’। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সরকারে এলে ‘যন্ত্রণাদায়ক ও কঠিন সংস্কারের’ পথে হাঁটবে বিএনপি। অনুষ্ঠানের প্রথম সেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কেএএস মুরশিদ। এতে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, বেসরকারি সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এবং বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্স যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা এখনো হাতে পাইনি। এ সময়ে তার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন টাস্কফোর্সের সভাপতি কেএএস মুরশিদ। টাস্কফোর্সে বক্তারা ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও রপ্তানি খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন। ৩০ জানুয়ারি অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত টাস্কফোর্স সদস্যরা সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ২৫ দিনেও সেটা বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে পৌঁছেনি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বিগত সময়ে দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল। ‘ব্যাংকিং সেক্টর ও নানা অবকাঠামো নির্মাণে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে আমাদের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আসে। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।’ শেখ বশিরউদ্দীন আরও বলেন, গত সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ওই সময় বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, একসময় যেভাবে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ হয়েছিল, এখন সেভাবে তা হবে না। সে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি সম্প্রসারণ করতে হবে।
ড. রেহমান সোবহান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সমস্যা কী, সে বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। অনেকদিন ধরেই এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজে অন্তত এক হাজার অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছি। কিন্তু কেন সমস্যার সমাধান হয় না বা কোথায় গিয়ে সব আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা দরকার। টাস্কফোর্সের কাছে প্রত্যাশা ছিল, সংস্কার কেন আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা থাকবে।’
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, কোনো দেশের যদি সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ থাকে এবং এই অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে এটি অবশ্যই খুব আকর্ষণীয় বাজার। যারা বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিয়ে এসেছে, তারা এই বাজারকে লক্ষ্য করে এসেছে। তাই এই বাজারকে পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কি না, কীভাবে গুণগত উন্নতি করা যায়, এ বিষয়টি ভাবতে হবে। সিপিডি চেয়ারম্যান আরও বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে গত ৩০ বছরে যে বিষয়গুলো বিকল্প হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এখনো তার সমাধান হয়নি। যতক্ষণ সঠিকভাবে এটি নির্ণয় না করা যাবে, ততক্ষণ ভবিষ্যতের জন্য সত্যিকারের নীতি সংস্কারের পরামর্শ দিতে পারব না। তাই এটি একটি বড় অমীমাংসিত সমস্যা।
ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ জরুরি। এক্ষেত্রে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের রপ্তানিখাত গার্মেন্টের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এ খাতে বড় কোনো সমস্যা হলে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তার মতে, তৈরি পোশাকখাতের পাশাপাশি দেশের অন্য খাতের রপ্তানি বিকাশের সুযোগ আছে। সেলিম রায়হান বলেন, তৈরি পোশাক খাতেরও সম্প্রসারণের সুযোগ আছে। দেশে যে পোশাক তৈরি হয়, তা মূলত তুলাভিত্তিক। যদিও বিদেশে কৃত্রিম সুতাভিত্তিক পোশাকের বাজার আছে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতকে যে ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, অন্যখাতেও সে ধরনের সুযোগ দেওয়া উচিত।
আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চলমান ‘টুকটাক, ছোটখাট, সংস্কার দিয়ে দেশের তেমন কাজে আসবে না। সরকারে এলে ‘যন্ত্রণাদায়ক ও কঠিন সংস্কারের’ পথে হাঁটবে বিএনপি। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সরকার গঠন করার পর উদার ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত বাণিজ্যে জোর দেবে। তিনি বলেন, অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সরকারের রোল (ভূমিকা) কমিয়ে আনব। তিনি সংস্কারের ভাবনা তুলে ধরে বলেন, এটা হবে যন্ত্রণাদায়ক সংস্কার। এটা হবে কঠিন সংস্কার। এখানে হয়তো কিছু প্রতিরোধও থাকবে। আমির খসরু বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশিদের উদ্বেগ রয়েছে। কারণ বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস রিপোর্টে (সহজে ব্যবসা করা সংক্রান্ত সূচক) বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। এ ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো না। শেয়ারবাজারের অবস্থা আরও খারাপ। এ দুই খাতে সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।
ব্যাটারি রিকশার বিষয়ে আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নয়-জ্বালানি উপদেষ্টা : বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে আপাতত ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। এটা এখন একটি গণপরিবহণ হয়ে উঠেছে, তাছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশার মাধ্যমে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সোমবার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ আয়োজিত এক কনফারেন্সে তিনি এসব কথা বলেন।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ দুই খাতে বেশি খরচ হয়। তার মধ্যে একটি হলো সেচ, আরেকটি কুলিং লোড। সেচের মাধ্যমে যেহেতু কৃষিকাজ হয়ে থাকে, তাই খাদ্যসংকট যাতে না হয়, সেজন্য আমরা এ খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব।
তিনি বলেন, এসির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় যে কুলিং লোড বা বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়, তা চাইলে সাশ্রয় করা সম্ভব। আমরা যদি এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে ব্যবহার করি তাহলে ৩ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয় হবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, এসি ব্যবহারের এই নির্দেশনাটি আমরা পর্যবেক্ষণ করব। যে এলাকায় দেখা যাবে যে কুলিং লোড বেশি ব্যবহৃত হবে, অর্থাৎ ফিডারে বেশি চাপ দেখা যাবে, আমরা সে এলাকায় লোডশেডিং করব। এবারের লোডশেডিংয়ে শহর এবং গ্রামকে সমান প্রাধান্য দেওয়া হবে।
কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম, ড. ইজাজ হোসেন প্রমুখ।