Logo
Logo
×

অর্থনীতি

খেলাপি ঋণ নিয়েও হাসিনা সরকারের ‘চালবাজি’

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪০ পিএম

খেলাপি ঋণ নিয়েও হাসিনা সরকারের ‘চালবাজি’

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে ব্যাংক খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। ঋণ বিতরণে পুকুরচুরির পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নবায়নেও বিভিন্ন অপকৌশল নিয়েছিল হাসিনা সরকার।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খেলাপি কম দেখাতে নানারকম ছাড় দেওয়া হয়েছে। ঋণ পুনঃতফশিলের নীতিমালা সহজ করে ২০২২ সালে পুরো প্রক্রিয়া ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে পুনঃতফশিলের জন্য আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসতে হচ্ছে না। আগে যেখানে একটি ঋণ পুনঃতফশিলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। আর তিন দফায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য পুনঃতফশিল করা যেত। এর বাইরে সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসতে হতো। অথচ নতুন নীতিমালায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনঃতফশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। আর ডাউনপেমেন্ট ধরা হয় মোট বকেয়ার আড়াই শতাংশ। আগের সরকারের লুকানো তথ্য বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পুনঃতফশিল ঋণ বেড়েছে।

ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ২০ হাজার ৭৩২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে অধিকাংশ ব্যাংক। যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ১৮ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এরপরও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমেনি, উলটো বেড়েছে।

আগের সব রেকর্ড ভেঙে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

যদিও ডিসেম্বরভিত্তিক খেলাপি ঋণের আনুষ্ঠানিক তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। মঙ্গল-বুধবারের মধ্যে হতে পারে। 

তবে অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ নবায়ন বা পুনঃতফশিল করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। যার পরিমাণ ১৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো করেছে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর পুনঃতফশিল ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। তবে বিদেশি ব্যাংকগুলো এ সময় কোনো খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিল করেনি।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর পুনঃতফশিল না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অন্য ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এটা পুরো উলটো। এসব ব্যাংক সব সময় ছোট ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। এছাড়া বিদেশি ব্যাংক যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো ঋণ দেয় না।

রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে কেউ ঋণ নিতে পারে না। তাই তাদের খেলাপি ঋণ কম। খেলাপি ঋণ কম থাকার কারণে তাদের পুনঃতফশিল করতে হয় না। অপরদিকে অন্য ব্যাংকগুলো বড় বড় লুটেরা ও দুর্নীতিবাজকে ঋণ দিয়ে আদায় করতে পারে না। একটা সময় এসব ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে পুনঃতফশিল করার জন্য চাপ দেয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে যেসব ঋণ নেওয়া হয় সেসব ঋণ বছরের পর বছর কোনো টাকা পরিশোধ না করে নবায়ন করা হয়। সে কারণে ঋণ নবায়নের পরিমাণ বেড়েছে।

জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, এখন আর আগের মতো তথ্য লুকানো হয় না। সে কারণে খেলাপি ও নবায়ন উভয়ই বাড়ছে। এটা আরও বাড়তে থাকবে। এতে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতিও বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে মূলধন ঘাটতি। সর্বোপরি এর বিরূপ প্রভাব বৈদেশিক বাণিজ্যেও পড়বে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও কিছু বাস্তবতা আছে। সেটা হলো-গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। সে কারণে খেলাপি ও ঋণ নবায়ন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অতি ছাড়ও নয়, আবার অতি কড়াকড়িও নয়-এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ ব্যবসা বাঁচলে ঋণ পাওয়া যাবে। না বাঁচলে ঋণও ফেরত পাওয়া যাবে না।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ চাপে পড়েছেন। কারণ খরচ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেভাবে আয় হচ্ছে না। অপরদিকে কিছু ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার পরিস্থিতিও নেই। এসব ব্যাংকের ব্যবসায়ীরাও সংকটে রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিল করতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, গত সরকার ব্যাংক খাতের অনেক তথ্য লুকিয়ে রেখেছিল। বর্তমান সরকার লুকানো জিনিস সব বের করে বাস্তব চিত্র দেখতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক চাপ না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও লুকানো জিনিস প্রকাশ করছে। 

গভর্নর ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ ৩০-৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এসব কারণে পুনঃতফশিল বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিলে ছাড় দেওয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উলটো যে ঋণগুলো পুনঃতফশিল মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে টালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফশিল বা নবায়ন করা ঋণস্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ঋণ আবার খেলাপি হয়ে গেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম