চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মেয়াদের দ্বিতীয় দফার মুদ্রানীতি প্রণয়ন নিয়ে বহুমুখী চাপ অনুভব করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ চাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার না কমা পর্যন্ত আরও কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হোক বা নীতি সুদের হার বাড়ানো। ব্যবসায়ীদের দাবি সুদের হার কোনোক্রমেই আর বাড়ানো যাবে না, বিদ্যমান হার স্থিতিশীল রেখে পর্যায়ক্রমে কমাতে হবে।
সাধারণ মানুষের চাওয়া মূল্যস্ফীতি কমানো, টাকার মান ও আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অর্থনীতিবিদদের অভিমত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একপাক্ষিক পদক্ষেপ না নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি সুদের হার বাড়ানোর নীতিগত সদ্ধিান্ত নিয়েও বহুমুখী চাপে এখন আবার তা পর্যালোচনা করছে। মুদ্রানীতির উপকরণগুলোর একটি শিথিল করলে অন্যটিতে চাপ বাড়ছে। এতে উভয় সংকটে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার জন্য প্রাথমিকভাবে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রস্তুতির প্রয়োজনে এ তারিখ পরিবর্তনও করা হতে পারে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা গেছে, নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন অংশীজন বা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের
সঙ্গে বৈঠক করবে। সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
পাশাপাশি দেশের ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও
সম্ভাবনাগুলো পর্যালোচনা করে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ তৈরি করা হবে। এর মধ্যে
একটি থাকবে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে ব্যবসায়ী ও
ভোক্তাদের স্বসি্ত দেওয়া যায়। অপরটি থাকবে সুদের হার না বাড়িয়ে কীভাবে
মূল্যস্ফীতি লাগাম টানা সম্ভব হয়। এমন একটি প্রতিবেদন মুদ্রানীতি কমিটিতে উপস্থাপন
করা হবে। কমিটি চূড়ান্ত সদ্ধিান্ত নেবে। এর আলোকে মুদ্রানীতি তৈরি করে পর্ষদের
অনুমোদন নেওয়া হবে। তারপর ঘোষণা করা হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ আইএমএফের ৪৭০ কোটি
ডলারের একটি ঋণ চুক্তির আওতায় রয়েছে। এর অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার
না কমা পর্যন্ত মুদ্রানীতিকে কঠোর করতে হবে। মুদ্রানীতি ব্যবহারের মাধ্যমে
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাত্ নীতি সুদের হার আরও বাড়াতে হবে। এ
হার বাড়ালে বাজারে ঋণের সুদের হার বেড়ে যাবে। এতে ব্যবসা খরচ বৃদ্ধি পাবে। ঋণের
প্রবাহ লাগাম টানতে হবে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান আরও কমবে। এছাড়া আইএমএফ
গ্যাস ও বিদু্যতের দামও বাড়াতে বলেছে। তবে সরকার এ সদ্ধিান্ত থেকে পিছু হটছে।
আইএমএফের সব শর্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংস্থাটি ঋণের চতুর্থ কিসি্তর অর্থছাড় পিছিয়ে
দিয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত ঋণ চুক্তি
অনুযায়ী চতুর্থ কিসি্তর অর্থ গত ডিসেম্বরেই ছাড় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন বলা
হচ্ছে আগামী মার্চে ছাড় হবে। অর্থাত্ তিন মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিসি্তর অর্থও
কম ছাড় করবে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের হার ও কোটা অনুযায়ী ১০০ কোটি
ডলারের বেশি ছাড় করার কথা। কিন্তু তারা ছাড় করবে এর চেয়ে অনেক কম অর্থ। এমন
প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি কঠোর না করলে আইএমএফের পরামর্শ উপেক্ষা করা হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের দুটি
প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এতে তারা স্পষ্ট করেই বলেছেন, ঋণের সুদের হার আর
কোনোক্রমেই বাড়ানো যাবে না। শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্য বঁাচাতে হলে ঋণের সুদের হার
স্থিতিশীল রেখে পর্যায়ক্রমে কমাতে হবে। এ হার সিঙ্গেল ডিজিটে বা ৯ শতাংশের মধ্যে
নামিয়ে আনতে হবে। ব্যবসায়ীরা আরও বলেছেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। কিন্তু
এর দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে দাম বাড়ছে।
মুদ্রানীতির কৌশল নিয়ে শিগগিরই অর্থনীতিবিদ ও
গবেষকদের সঙ্গে বৈঠক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে তাদের
মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে ভোক্তারা চাচ্ছেন, মূল্যস্ফীতির হার কমানো,
পণ্যমূল্য হ্রাস, নতুন কর্মসংস্থান বাড়ানো, আগের কর্মসংস্থান ধরে রাখা এবং আয়
বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক মুদ্রানীতির মাধ্যমে। জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে হলে ঋণের
সুদের হার, ডলারের দাম বাড়ানো যাবে না। বরং কমাতে হবে। পাশাপাশি ঋণের প্রবাহ
কমানো যাবে না, বরং বাড়াতে হবে। এটি করলে আবার মূল্যস্ফীতিতে চাপ বেড়ে যাবে। ফলে
এ রকম কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে
মূল্যস্ফীতির হার কমানো, বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করা, কর্মসংস্থান
সৃষ্টি। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সুদের হার কমাতে ও ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এতেও মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। ফলে দেশে বিদ্যমান
সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে উভয় সংকটে
পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে
নির্বাহীরা চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মেয়াদের দ্বিতীয় দফার মুদ্রানীতি প্রণয়ন
নিয়ে একটি বৈঠক করেছেন। এতে তারা দেশের ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নীতি
সুদের হার বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। নীতি সুদের হার বাড়লে বাজারে ঋণের সুদের হার
বেড়ে যাবে। ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। এতে ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়বেন। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও
এতে আপত্তি তুলেছেন।
এদিকে চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয় গত
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আগের চেয়ে এটি আরও কঠোর করা হয়। কিন্তু জুলাইয়ে
মূল্যস্ফীতি না কমে বরং রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়। আগস্টে
মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নামে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের
পতন হলে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে ২৭ আগস্ট প্রথম নীতি সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ
থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়। এর প্রভাবে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার আরও একটু
কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নামে। ২৫ সেপ্টেম্বর নীতি সুদের হার আরও এক দফা বাড়িয়ে সাড়ে
৯ শতাংশ করা হয়। এর প্রভাবে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কমেনি। বরং বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭
শতাংশে ওঠে। গত ২৭ অক্টোবর তৃতীয় দফায় নীতি সুদের হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
এতে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। বরং বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ওঠে। ডিসেম্বরে
এ হার আরেকটু কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নামে। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত নীতি সুদের
হার সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে তিন দফা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির
হার কমেনি। যেটুকু কমেছে তা শীতের সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমার কারণে। এ
প্রেক্ষাপটে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের
(বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড.
মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুদের হার বাড়িয়ে ও টাকার প্রবাহ
কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্য বাজার সিন্ডিকেট, কারসাজি, অতি
মুনাফার প্রবণতা রোধ করতে হবে। এগুলো করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা ছাড়া
শুধু এককভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের মাধ্যমে এ হার কমানো যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ
ব্যাংকের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তারা চায় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ভোক্তাকে
একটু স্বসি্ত দেওয়ার পদক্ষেপ নিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার প্রত্যাশার মধ্যে
বৈপরীত্যও রয়েছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়নের আগে সব অংশীজনের
মতামত নেবে। কিন্তু কোনো চাপ বা প্রত্যাশার দিকে এককভাবে নজর দেবে না। দেশের
অর্থনীতির স্বার্থে বেশির ভাগ মানুষের জন্য যেটি সুফল বয়ে আনবে সে রকম পদক্ষেপই
নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, এবারের মুদ্রানীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ
হিসাবে রাখা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের কেৌশল। ডলারের বিপরীতে টাকার
বিনিময় হারে ইতোমধ্যে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। টাকার মান না কমার ফলে আগামীতে
মূল্যস্ফীতিতে চাপও কমবে। পাশাপাশি উত্পাদন খাতে (শিল্প ও কৃষি) ঋণের জোগান
বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যাতে উত্পাদন বাড়ে। বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতিও নজর
দিতে সংশি্লষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি অনুরোধ জানানো হবে।