সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় পরিবর্তন, গ্রাহকের কী লাভ?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৪ পিএম
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি গত সপ্তাহে এমন কয়েকজন গ্রাহক পেয়েছেন, যারা ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রিনিউ না করে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।
তার মতে, গ্রাহকদের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের ব্যাপারে কৌতূহল বেড়েছে।
তবে তিনি এটাও জানান, তাদের শাখায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি।
নতুন বছরের শুরুতেই সঞ্চয়পত্রের জন্য নতুন মুনাফার হার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ গত ১৫ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ফলে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেড়েছে। পূর্ণ মেয়াদে কোনোটির হারই ১২ শতাংশের কম নয়। আগে এই হার ছিল ১২ শতাংশের নিচে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৬ মাস পর সঞ্চয় স্কিমের মুনাফার হার পুনরায় নির্ধারণ করা হবে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এর মধ্য দিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।
তবে গত ১ জানুয়ারির আগে কেনা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা আগের হারেই মুনাফা পাবেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়। এর আগে নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এসব হার নির্ধারণ করা হতো।
বিনিয়োগের জন্য দুটি পরিসীমা বা স্তরে বিভাজন করার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রথম স্তর। সাড়ে ৭ লাখের ওপরে দ্বিতীয়টি। অর্থাৎ সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগকারীরা যে হারে সুদ পাবেন, এর চেয়ে বেশি অংকের বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাবেন তার চেয়ে কিছুটা কম হারে।
আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য অনূর্ধ্ব ১৫ লাখ, ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ এবং ৩০ লাখের ঊর্ধ্বে- এমন তিনটি ধাপ ছিল। এছাড়াও ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে সুদের ওপর ৫ শতাংশ হারে এবং ১৫ লাখের বেশি অংকের বিনিয়োগে সুদের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসমূলে কর কেটে রাখা হয়।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সময় যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া উচিতসঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সময় যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া উচিত
কোন সঞ্চয়পত্রে কেমন মুনাফা?
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে মোট ৯টি সঞ্চয় কর্মসূচি রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটির মুনাফার হার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালের জন্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
এগুলো হলো-
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র- এই স্কিমে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তিতে মুনাফার হার ১২.৪০ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি হলে ১২.৩৭ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র- প্রথম ধাপের জন্য মেয়াদ শেষে হার ১২.৩০ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২.২৫।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র- সবচেয়ে বেশি মুনাফা ধরা হয়েছে পেনশনার স্কিমে। পাঁচ বছরের মেয়াদ পার হলে প্রথম স্তরের জন্য ১২.৫৫ শতাংশ। দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের জন্য এই হার ১২.৩৭ শতাংশ।
পরিবার সঞ্চয়পত্র- বাংলাদেশে পরিবার সঞ্চয়পত্রের কেনার প্রবণতা বেশি দেখা যায় বলে অভিমত ব্যাংক কর্মকর্তাদের। এই স্কিমে দুই ধাপে যথাক্রমে ১২.৫০ শতাংশ ও ১২.৩৭ শতাংশ সুদহার ধার্য করা হয়েছে।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক মেয়াদি হিসাব- তিন বছর মেয়াদী স্কিমটির ক্ষেত্রে ১২.৩০ শতাংশ ও ১২.২৫ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে সরকার।
প্রবাসীদের জন্য থাকা ৩টি বন্ড এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক সাধারণ হিসাবসহ ৪টি স্কিম অপরিবর্তিত থাকার কথা জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে।
মেয়াদের আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙালেও পাওয়া যাবে বাড়তি মুনাফামেয়াদের আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙালেও পাওয়া যাবে বাড়তি মুনাফা
গ্রাহকের কী লাভ?
বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বিনিয়োগের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছে সঞ্চয়পত্র কেনা। নিয়মিত ও ঝুঁকিহীন আয়ের ব্যবস্থা হয় এতে। লাখ-লাখ পরিবার আছে যারা সঞ্চয়পত্র থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে তাদের পারিবারিক ব্যয় চালান। তবে বিগত বছরগুলোয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে সরকার নানা ধরনের নিয়মকানুন আরোপ করে। ২০২১ সালে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দিলে অনেকেই এতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারান। ফলে মানুষ সঞ্চয়পত্রের বদলে শেয়ার বাজার বা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করবে, ২০২২ সালে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক চাপ। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, সুদের হার কমে যাওয়ায় লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। জনসাধারণ সঞ্চয়পত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতো না। অনেকে এই সময়ে ব্যাংক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সুদের হার কমপিটিটিভ (প্রতিযোগিতামূলক) করা হয়েছে বলে মনে করি। নেট বিক্রি বেশি হলে সরকারে হাতে টাকা আসবে।
কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো বহাল। সাংসারিক ব্যয় ও নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে পূর্ণ মেয়াদের আগেই সঞ্চয়পত্রের অর্থ তুলে ফেলা মানুষও কম নয়। হাবিবুল ইসলাম নামে একজন বলছিলেন, টাকার টানাটানি পড়ে গিয়েছিল, তাই সঞ্চয়পত্রটা ভেঙে ফেলতে হয়েছে।
দেশে শরিয়াহভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর দাবিতে লিগ্যাল নোটিশদেশে শরিয়াহভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর দাবিতে লিগ্যাল নোটিশ
অর্থনীতিবিদ কে মুজেরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, সহসা মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সামনে রমজান, তাই মূল্যস্ফীতি বরং আরও উচ্চ হতে পারে। এমন অবস্থায় সুদের হার বাড়ালেই বিক্রয় এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়বে কি-না, এটি একটি প্রশ্ন।
এ বিষয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানান, মানুষকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করতেই সুদহার বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগটি তারা বাস্তবায়ন করছেন।
অবশ্য, অর্থনীতিবিদ কে মুজেরী মনে করেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
তিনি বলেন, মুনাফার হার বাড়ানোয় সঞ্চয়পত্রের ওপর যাদের পারিবারিক ব্যয় নির্ভরশীল, তারা উপকৃত হবেন। এখন সঞ্চয়পত্র থেকে যে আয়টা হয়, সেটা কিছুটা হলেও বাড়বে। ফলে তাদের হাতে কিছু বাড়তি অর্থ আসবে, যা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার কিংবা সন্তানের পড়ালেখার ব্যয়বহনের মতো বিষয়গুলোতে কিছুটা সুবিধা তারা পাবেন।