বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
আর্থিক খাতের হুমকি উচ্চ খেলাপি ঋণ
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
প্রতীকী ছবি
ব্যাংক খাতে উচ্চ ঋণখেলাপি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলছে, ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদ্যমান উচ্চ খেলাপি ঋণ আর্থিক খাতের অগ্রগতিতে বিরাট হুমকিস্বরূপ। খেলাপি ঋণ বেশি হলে ব্যাংকগুলোকে এই ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বাড়াতে হয়। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির জন্য মূলত খেলাপি ঋণই দায়ী। খেলাপি ঋণ কমানো ছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থায় মূলধন পর্যাপ্ততার কোনো উন্নতি হবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন এক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের মন্তব্য করল, যখন ঋণ দেওয়ায় অনিয়ম, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতায় ব্যাংকিং খাত খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত।
তাদের মতে, এর জন্য এক নম্বর দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। ব্যর্থ এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার কারণেই এমনটি হয়েছে। বছরের পর বছর ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। জাল-জালিয়াতদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এসবেরই ফসল আজকের উচ্চ ঋণখেলাপি। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ এখন আর হুমকি পর্যায়েও নেই। এটা মহাবিপদ সংকেত পর্যায়ে চলে গেছে। যাই হোক, বিলম্বে হলেও বলছে- উচ্চ খেলাপি ঋণ আর্থিক খাতের অগ্রগতিতে বিরাট হুমকিস্বরূপ। কিন্তু এই হুমকির কারণ কী? কারা এর জন্য দায়ী। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ডিসেম্বরে অবশ্য খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় নামে, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১০ বছর ধরে ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোও মূলধন ঘাটতিতে আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে যথেষ্ট নিয়মনীতি আছে। সমস্যাটা পরিপালনে। যে কারণে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি তিন ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে। পরিদর্শনে গিয়ে প্রথমেই একটি বায়োডাটা ধরিয়ে দেয়, অমুককে চাকরি দিতে হবে। আবার অনিয়ম ধরা পড়লে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয় না। শুধু বিদেশের উদাহরণ দেওয়া হয়। উন্নত দেশে অনিয়ম ধরা পড়লে রক্ষা নেই। সেখানে ঋণখেলাপিরা দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারেন না। খেলাপিরা বিদেশে পেট্রোল কিনতে পারেন না, বাড়িভাড়া পান না, এমনকি বিমানেও চড়তে পারেন না। আর এখানে তারা ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পান। এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যাদের ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল, শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল চুরিদারি। যে কারণে নানা ছাড় দিয়ে এবং নাম পরিবর্তন করেও পদ্মা ব্যাংক বাঁচানো যায়নি। এখন এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে। একীভূতকরণের আড়ালে অনিয়মে জড়িত পরিচালক ও কর্মকর্তারা কোনোভাবে যেন পার না পায়। ঋণখেলাপিরা যেন ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে না যায়। এসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের পর কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখতে হবে। প্রথমত, আমানতকারীর অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দিতে হবে। দুর্বল ব্যাংকের কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিচালনার সঙ্গে জড়িত দায়ীদের ছাড় দেওয়া যাবে না। দুর্বল ব্যাংকের কারণে যেন সবল ব্যাংক দুর্বল না হয়। এজন্য ভালো
লোকদের পরিচালনা পর্ষদে বসাতে হবে। ব্যবস্থাপনা থেকে পরিচালনা আলাদাভাবে চলতে দিতে হবে। এছাড়া আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কী বলল না দেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে। নির্দেশনার অপেক্ষায় বসে না থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কোথাও ব্যাংক দেওয়া হয় কিনা, তা জানা নেই। তিনি গভর্নর থাকা অবস্থায়ও নতুন ব্যাংক দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। দিচ্ছি, দেব করে তিনি সময় পার করেন। অথচ ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। সুশাসনের অভাবে এখন আবার ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে পায় না। তারা কি মাটির নিচে থাকে যে খুঁজে পাওয়া যাবে না? ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। এ সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। সুশাসন ফেরাতে ভালো সমাধান হলো, আমানতকারীর দায়দেনা মিটিয়ে ব্যাংক গুটিয়ে ফেলা। তবে এখানে দুর্বল হওয়া ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ দিতে পারছে না বলে ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর পদ্মা ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে সেখানে সরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ আনা হলো। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণে ছাড় দেওয়া হলো। বিশ্বের কোথাও এমন হয় কিনা, জানা নেই। তার মতে, অন্য কোম্পানির ব্যবসা থেকে ব্যাংক আলাদা। যে কারণে অন্য সব ব্যবসা থেকে ব্যাংকের জন্য আলাদা কিছু নীতিমালা করা হয়। অন্যের টাকায় ব্যাংক চলে। আস্থার কারণেই মানুষ ব্যাংকের কাছে আমানত রাখে। ফলে এখানে সুশাসন থাকা সবচেয়ে জরুরি। নৈতিকতার চর্চা এখানে প্রধান ইস্যু।