রোজাকে টার্গেট করে সক্রিয় সিন্ডিকেট,
বাজার থেকে উধাও হচ্ছে সয়াবিন তেল
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ পিএম
রোজা যত ঘনিয়ে আসছে, ভোজ্যতেলের বাজারে অসাধু চক্রের কারসাজি তত বাড়ছে। কোমর বেঁধে সক্রিয় হচ্ছে সেই পুরোনো সিন্ডিকেট। পরিস্থিতি এমন-রোজা শুরুর চার মাস আগেই কোম্পানিগুলো মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে। এতে ডিলার থেকে খুচরা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বাড়ানো হচ্ছে দাম। তবে বাড়তি দামেও চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। এতে বাজার থেকে এক প্রকার উধাও হচ্ছে সয়াবিন তেল। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে খোলাবাজারে। সোমবার রাজধানীর বেশকয়েকটি বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে তেলের দাম সহনীয় রাখতে ১৭ অক্টোবর পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সুবিধা কার্যকর থাকবে। তবে মাসের ব্যবধানে লিটারে ২০ টাকা বেড়ে খোলা সয়াবিন খুচরা বাজারে ১৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর লিটারে ৩ টাকা বেড়ে বোতলজাত বিক্রি হচ্ছে ১৬৭-১৭০ টাকা। সঙ্গে ১৫ দিনের ব্যবধানে পাম তেল ও রাইসব্রান তেলের দামও লিটারে ৬ থেকে ২০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। এতে আসন্ন রোজায় বাজার আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা। তারা বলছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও রমজানে বাড়তি দরেই ভোজ্যতেল কিনতে হবে।
সোমবার নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, ১৫ দিন আগেও পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৭৯০-৮০০ টাকা দিয়ে কিনে খুচরা পর্যায়ে ৮১৮ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন পাওয়া যাচ্ছে না। ডিলাররা অল্প পরিমাণে সরবরাহ করছেন। তাই ডিলাররা সংকট দেখিয়ে আজও (সোমবার) ৮১০ টাকা দিয়ে বিক্রি করেছে। তবে সরকার নির্ধারিত পণ্যের গায়ের লিখিত খুচরা মূল্য ৮১৮ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত তেলেও একই অবস্থা। এক লিটারের বোতলজাত সয়বিন তেল ১৬৭-১৭০ টাকা খুচরা মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ তেল ডিলারদের কাছ থেকে ১৬২ টাকা দিয়ে কিনতাম। এখন ১৬৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। রূপচাঁদা, তীর, বসুন্ধরা, ফ্রেশসহ সব কোম্পানি একই রেট ধরে দিচ্ছে।
তিনি জানান, আগে কম দামে কিনে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতাম। এখন কোম্পানি দাম বাড়ানোর পর আমাদের বেশি দামে সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে সেই সরকারি দামেই। এছাড়া কোম্পানিগুলোর ডিলাররা সয়াবিন তেল সরবরাহও অনেক কমিয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। চাহিদা দিয়েও অনেক কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদামাফিক বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি দিচ্ছে না। দশ কার্টন তেল চাহিদা দিলে দুই কার্টন তেল দেওয়া হচ্ছে। যে কারণেও খুচরা বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। যাতে রোজার আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করতে পারে। তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।
রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা সোহেল যুগান্তরকে জানান, বাজার থেকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডিলারদের কাছ থেকে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ১৮২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৮৫ টাকা। তবে ১৫ দিন আগেও তা ১৫৭-১৫৮ টাকায় ডিলারদের কাছ থেকে কিনতাম। খুচরা বিক্রি করতাম ১৬০ টাকা। তিনি জানান, দাম বাড়ায় খোলা সয়াবিন এখন বিক্রি করছি না। এটির দাম বোতল থেকে অনেক। তবে নিুবিত্ত ও খেটেখাওয়া মানুষ একবারে বেশি দামে দিয়ে এক লিটারের বোতলজাত তেলও কিনতে পারছে না। এতে খোলা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে কিছু বিক্রেতা খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় বোতলজাত তেলের মুখ খুলে খোলা তেলের ড্রামে ঢেলে বিক্রি করছেন। এতে বাজারে বোতলজাত তেলেরও সংকট দেখা দিয়েছে।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কাওরান বাজারে কথা হয় বিভিন্ন তেল কোম্পানির ডিলারদের সঙ্গে। তারা যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানি থেকে আমাদের তেল সরবরাহ করছে না। কম করে সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে। যেখানে একজন ডিলারের চাহিদা ১০০ কার্টন, সেখানে কোম্পানি ২০-৩০ কার্টন তেল দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কমাতে হচ্ছে। যে কারণে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিচ্ছে। তবে কোম্পানিগুলো বলেছে কিছুদিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
অন্যদিকে খুচরা বাজারে খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৬ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৫০ টাকা ছিল। আর পাম অয়েল সুপার বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৬০ টাকা, যা আগে ১৫৪ টাকা ছিল। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত রাইসব্রান তেল বিক্রি হচ্ছে ২০০-২১০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে লিটারপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৮৫-১৯৫ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলজাত রাইসব্রান তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৮০-১০৫০ টাকা, যা সাতদিন আগেও ৮৮০-৯২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর তিন থেকে চার মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। তাই এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়, এর প্রায় সবকটির দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহণ খরচ কমেছে। দেশে ডলারের দামও কমেছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার কিনতে হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করে। এখন তা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ১০৫ ডলার। গত আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১ ডলারে, সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এর দাম নিুমুখী। গত ডিসেম্বরের তুলনায় সয়াবিনের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী।
সোমবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের বাড়তি দামের কারণে অন্যান্য ভোজ্যতেলের দাম বেশি। রপ্তানিকারক দেশগুলো পাম তেল ব্যবহার করে বায়োডিজেল উৎপাদন বাড়াচ্ছে। দেশের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানির ওপর ভ্যাট কমিয়ে পাঁচ শতাংশে আনা প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সার্বিকভাবে তদারকি অব্যাহত আছে। ভোজ্যতেলের বিষয়টিও দেখা হবে। অনিয়ম বের হয়ে এলে আইনের আওতায় আনা হবে।