স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে যেভাবে ঈদযাত্রার প্রস্তুতি
ডা. তাহমীদ কামাল
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৪ এএম
ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। সবাই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। যাত্রাপথে কম-বেশি সবাইকেই পোহাতে হয় ঝক্কি-ঝামেলা। ঈদযাত্রায় কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখবেন সেই পরামর্শ দিয়েছেন ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমীদ কামাল।
ঈদ ভ্রমণে নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ থাকতে প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি। এ সময় আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শরীর খারাপ হতেই পারে। তাই ভ্রমণে অবশ্যই একটি ওষুধের ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। সঙ্গে নিন স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ। নিম্নোক্ত ওষুধ এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে ঈদযাত্রায় শরীর খারাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ভ্রমণের সময় যে শারীরিক সমস্যাগুলো সাধারণত হতে পারে-
▶ ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা : এ গরমে ডিহাইড্রেশন থেকে সাবধান। সঙ্গে রাখুন জুস এবং স্যালাইন পানি।
▶ পেট খারাপ/লুজ মোশন : চেষ্টা করবেন বাইরের কিছু না খেতে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ইমার্জেন্সি এন্টিবায়োটিক ওষুধ সঙ্গে রাখুন। এছাড়া পথে অপরিচিত লোকের দেওয়া কোনো খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
▶ বমি ভাব/মোশন সিকনেস : অনেকে আছেন যাদের গাড়িতে উঠলে বমি ভাব হয়। তাই সঙ্গে রাখুন এন্টিইমিটিক/ বমির ওষুধ যেমন ডমপেরিডন।
▶ অ্যাজমা অ্যাটাক/শ্বাসকষ্ট : অ্যাজমা/ শ্বাসকষ্টের রোগীরা সঙ্গে রাখুন ইনহেলার।
▶ ডায়াবেটিস (হাইপো/হাইপারগ্লাইসেমিয়া) : এ রোগীরা সঙ্গে রাখুন ডায়াবেটিসের ওষুধ।
▶ কাটাছেঁড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা ম্যানেজ করার জন্য ফাস্ট এইড বক্স সঙ্গে রাখুন।
▶ গর্ভবতীরা সঙ্গে রাখুন প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং মেডিকেল রিপোর্ট।
▶ কোমর/ হাঁটুব্যথার রোগীরা অবশ্যই কোমরের লাম্বার করসেট বেল্ট এবং হাঁটুর ‘নী ক্যাপ’ সঙ্গে রাখুন।
* গ্যাসের ওষুধ
গ্যাসের ওষুধ বলতে আমরা সাধারণত সেসব ওষুধ বুঝি যা পেট জ্বালা পোড়া করলে খাওয়া হয়। যেমন ওমিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল, র্যাবিপ্রাজল, অ্যান্টাসিড ইত্যাদি। ঈদে বেশিভাগ মানুষই ভাজাপোড়া খান। যা থেকে পেটের গ্যাস হতে পারে। তাই ভ্রমণের আগে অবশ্যই সঙ্গে রাখুন গ্যাসের ওষুধ। শুধু পেট জ্বালাপোড়া করলেই কেবল গ্যাসের ওষুধ খাবেন। মনে রাখবেন, মাত্রাতিরিক্ত গ্যাসের ওষুধ সেবন করা ক্ষতিকর, যা দীর্ঘমেয়াদে খেলে আপনার হাড়ক্ষয়েরও কারণ হতে পারে।
* বমির ওষুধ
অনেককেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। যা থেকে হতে পারে ‘মোশন সিকনেস’ বা যানবাহনের ঝাঁকুনির কারণে বমি। রাস্তার মাঝখানে হয়তো ওষুধের দোকান পাবেন না। তাই সঙ্গে অবশ্যই রাখুন বমির ওষুধ, যেমন-ডমপেরিডন। গর্ভবতীরা এটা বিশেষভাবে সঙ্গে রাখবেন। ভ্রমণকালে যতটা পারেন কম খাওয়া-দাওয়া করবেন এবং প্রচুর পরিমাণে ফ্লুইড বা তরল জাতীয় খাবার খাবেন।
* ব্যথার ওষুধ
অনেকেই আছেন যারা কোমর ব্যথায় ভুগছেন। তাদের জন্য দীর্ঘ জার্নি করা পীড়াদায়ক। আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ এবং মাসল রিলাক্সেন্ট সঙ্গে রাখুন। এসব ওষুধ শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। উদাহরণস্বরূপ-ন্যাপ্রোক্সেন, মায়োল্যাক্স ইত্যাদি। এছাড়াও যাদের কোমর ব্যথা আছে তারা অবশ্যই ভ্রমণের সময় লাম্বার করসেট বেল্ট ব্যবহার করবেন। তাহলে রাস্তার ঝাঁকুনির কারণে যে কোমর ব্যথা হয় তা থেকে মুক্তি পাবেন। এছাড়া যাদের পায়ে/গোড়ালিতে ব্যথা আছে তারা অবশ্যই ভ্রমণের সময় নরম জুতা/কেডস জুতা ব্যবহার করবেন। জুতা শক্ত হলে সিলিকন সোল/হিল প্যাড ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনাকে ভ্রমণের সময় আরাম দেবে।
* সর্দি, কাশির ওষুধ
ঘুরতে গিয়ে সর্দি, কাশিতে ভুগলে অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ খেতেই পারেন। এ ওষুধগুলো কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে কার্যকরী। যেমন-ফেক্সোফেনাডিন, সেট্রিজিন ইত্যাদি। সেসঙ্গে নিয়মিত ভেপার নিন ও গার্গল করুন। তাহলেই এ রোগ থেকে দ্রুত মুক্তি পাবেন। চেষ্টা করবেন বেশি রোদে না যেতে এবং যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে।
* পেট খারাপ/লুজ মোশান
ভ্রমণের সময় পেট খারাপ/লুজ মোশানের সমস্যায় পড়লে ঝামেলার শেষ থাকবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে পারে ওআরএস স্যালাইন। এক লিটার পানিতে এক প্যাকেট ওরস্যালাইন মিশিয়ে ধীরে ধীরে পান করুন। এতেই কিন্তু উপকার পাবেন। এছাড়াও ডিহাইড্রেশন হলেও মুখে খাওয়ার স্যালাইন উপকারী। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ইমার্জেন্সি এন্টিবায়োটিক ওষুধ সঙ্গে রাখতে পারেন।
* ডায়াবেটিসের ওষুধ
ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভ্রমণের আগে অবশ্যই ডায়াবেটিসের ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে। যে কোনো কারণে পথে-ঘাটে যদি আপনার উপসর্গ দেখা যায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের অনেক সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যায় বা ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’ হয়ে যায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা অবশ্যই কিছু মিষ্টিজাতীয় খাবার সঙ্গে রাখুন। হাইপোগ্লাইসেমিয়া-এর উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হলো- মাথা ঘোরা, হতচকিত বা অচেতন অবস্থা, মাথা ধরা বা ঝিমঝিম করা, প্রচুর খিদে পাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ঘামানো, অত্যন্ত দুর্বল বোধ করা, শরীর কাঁপতে থাকা ও শীতল হয়ে আসা। যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা হাইপো অবস্থা এড়াতে চিকিৎসকের নির্দেশমতো এবং সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করবেন। পকেটে সবসময় চিনিযুক্ত খাবার রাখুন। বেশি খারাপ বোধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে রক্তে শর্করার পরিমাপ মেপে দেখবেন এবং সেটি কমে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
* হাঁপানি/শ্বাসকষ্টের ওষুধ
যাদের হাঁপানি/শ্বাসকষ্ট আছে তারা অবশ্যই সঙ্গে রাখুন ইনহেলার এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ। রাস্তায় ধুলাবালিতে অনেকের অ্যাজমার অ্যাটাক হতে পারে। তাই সঙ্গে অবশ্যই এ ওষুধগুলো রাখা জরুরি। ভ্রমণকালে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করুন। মাস্ক আপনাকে শুধু ধুলাবালি থেকেই রক্ষা করবে না, বরং রক্ষা করবে নানা রকম বায়ুবাহিত রোগ থেকে, যেমন করোনা, যক্ষ্মা ইত্যাদি।
* প্রেসারের ওষুধ
যারা ব্লাড প্রেসারজনিত সমস্যায় ভুগছেন তারা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রেসারের ওষুধ রাখবেন। পথে ওষুধ খাওয়ার সময় হলে তা যথাযথভাবে খেয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও যাদের হৃদপিণ্ডে সমস্যা/বুক ধড়ফড় করে তাদের সেই অনুযায়ী ওষুধ সঙ্গে রাখা জরুরি। এতে করে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
* গর্ভবতীদের জন্য পরামর্শ
ভ্রমণকালীন গর্ভবতীরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় ভ্রমণের সময় বমি হওয়াটা স্বাভাবিক। এজন্য বমির ওষুধ সঙ্গে রাখা জরুরি। অনেকের মাইগ্রেন এবং রাস্তার ধুলাবালিতে সমস্যা থাকে। গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ওষুধ সেবন করা যায় না। তাই ডাক্তারকে নিজের সমস্যার কথা বলে প্রয়োজন মতো ওষুধ সঙ্গে রাখা শ্রেয়।
* ফাস্ট এইড কিট
ভ্রমণের সময় যে কোনো কারণেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। কারও হয়তো হাত পা ছিলে যেতে পারে। তাই অবশ্যই সঙ্গে রাখুন ফাস্ট এইড বক্স। ফাস্ট এইড বক্স হলো একটি ছোট বাক্স বা থলি যাতে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সবরকম জরুরি উপকরণ মজুত থাকে। প্রয়োজনের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স সঙ্গে থাকলে খুব দ্রুত ও সহজেই যে কোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা যায়। ভ্রমণে এ বাক্সটি হতে পারে অসময়ের বন্ধু।
এ বক্সে যা যা রাখবেন তা হলো-
▶ জীবাণুনাশক সলিউশন, যেমন ডেটল, হ্যাক্সিসল ইত্যাদি
▶ ওয়ান টাইম ব্যান্ড এইড
▶ পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধকারী মলম, যেমন বার্না ক্রিম
▶ কাঁচি, রোল ব্যান্ডেজ/ক্রেব ব্যান্ডেজ
▶ অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, যেমন-স্যাভলন, ডেটল, হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড, পভিসেভ ইত্যাদি।
▶ তাপমান যন্ত্র বা থার্মোমিটার।
ভ্রমণের সময় আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শরীর খারাপ হতেই পারে। উপযুক্ত ওষুধ এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে এটা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে অসুস্থতা বাড়াবাড়ি পর্যায় পৌঁছালে অবশ্যই নিকটতস্থ হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।