নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া যায় কি?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মহসিনা আক্তার
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫৬ এএম
![নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া যায় কি?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/04/11/image-664613-1681192570.jpg)
শফিক আহমেদ (ছদ্মনাম) বয়স ৪০। বেশ কিছুদিন ধরে শরীর দুর্বল লাগে, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস হয় এবং স্বাভাবিক কাজে মনোযোগহীন। ডাক্তার রক্তের রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হলেন তিনি সাধারণ আয়রনের ঘাটটিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। চিকিৎসক তাকে দ্রুত তিন ব্যাগ রক্ত নিতে বললেন। শফিক আহমেদ বাসায় এসে সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘রক্ত যদি নিতেই হয় তবে অন্য বংশের কারও শরীরের রক্ত নেব না। আমার সহোদর ভাই করিম (ছদ্মনাম)’র রক্ত নেব। কারণ আমাদের রক্ত গ্রুপ এক এবং নিকটাত্মীয়ের রক্তই সবসময় নিরাপদ।’
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিন ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। এরপর শফিক সাহেবের শরীরে ধীরে ধীরে লাল লাল ছোপ দাগ, বমি বমি ভাব, ত্বক হলদে হওয়া’সহ আরও অনেক লক্ষণ দেখা গেল। তিনি দ্রুত একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ (হেমাটোলজিস্ট) তার রক্তপরিসঞ্চালনের সব ইতিহাস শুনে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট দেখে বললেন, শফিক সাহেব Trasfusion Associated graft versus host disease (TA-GVHD) রোগে আক্রান্ত। এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। কারণ তার সাধারণ আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা ছিল। শুধু রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের রক্ত নেওয়ার কারণে তার এ মৃত্যু।
TA-GVHD রক্ত পরিসঞ্চালন পরবর্তী একটি বিরল রোগ। এ রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা শতভাগ। রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের শরীর থেকে রক্ত নিলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া হলেও আবার TA-GVHD হয় না, কারণ রোগটি বিরল।
TA-GVHD কার হয় না
রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে গ্রহীতার ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) স্বাভাবিক থাকার কারণে এবং দাতা আবশ্যিকভাবে এইচএলএ না মেলার কারণে গ্রহীতার নিজের সক্ষম ও বিপুল সংখ্যক সাইটোটক্সিন টি-লিম্ফোসাইটগুলো দাতার রক্তের সঙ্গে থাকা টি-সেল’সহ সব নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষকেই তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করে ফেলে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে TA-GVHD ঘটতে পারে না। এ কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নিয়েও সমস্যা হয় না।
কার TA-GVHD হয়
এইচএলএ হলো কোষকলা ম্যাচিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিন। ব্লাড ক্যানসার ও বিএমটি’র চিকিৎসায় এইচএলএ জিন ম্যাচিং আবশ্যক। কিন্তু সাধারণ ব্লাড ট্রান্সফিউশনে এইচএলএ জিন ম্যাচিংয়ের বালাই নেই। রক্তগ্রহীতা ও রক্তদাতার এইচএলএ প্যাটার্ন যদি এমন হয় যে, গ্রহীতা দাতার সাইটোটক্সিন টি-লিম্ফোসাইটকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত না করে বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করে ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে গ্রহীতার শরীরে বেঁচে যাওয়া দাতার টি-লিম্ফোসাইট গ্রহীতার কোষ কলাগুলোকেই অপরিচিত শত্রু ভেবে ধ্বংস করে। তখনই TA-GVHD হয়। অর্থাৎ নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নিলে এমনটি হয়। কোনো বিশেষ মুহূর্তে যদি নিকটাত্মীয়ের রক্ত নিতেই হয় তবে রক্ত ইরেডিয়েট (রেডিয়েশন) করে নিলে TA-GVHD হয় না। এ রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা হলো স্কিন বায়োপসি।
আমরা দিনের পর দিন একটি প্রচলিত ভুল ধারণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যে, রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নিতে হবে। এ ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ সম্পর্কে একটি কুসংস্কার আছে। ‘সাধারণ মানুষ মনে করে অন্য কোনো বংশের রক্ত দেহে নিলে ওই বংশের বৈশিষ্ট্যগুলো চলে আসবে। এজন্যই তারা চিন্তা করে, রক্ত যদি নিতেই হয় তবে রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকেই নিব।’ এসব কারণে TA-GVHD নামক মরণঘাতী রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া এশিয়া মহাদেশের মানুষের এক সাধারণ সমস্যা। যে কোনো বয়সের যে কোনো মানুষের রক্তস্বল্পতা হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতাই বেশি দেখা যায়। রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে আগে একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। রক্ত নেয়া ছাড়া শুধু পুষ্টিকর খাবার ও ওষুধের মাধ্যমেই সাধারণ রক্তস্বল্পতা দূর হতে পারে।
লেখক : প্রভাষক, জীববিজ্ঞান, ধনবাড়ি সরকারি কলেজ, টাঙ্গাইল।