ডেঙ্গু জ্বর থেকে নিরাপদে থাকুন
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
ডেঙ্গু জ্বর থেকে নিরাপদে থাকুন
জলবায়ু পরিবর্তনে সারা দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টির ধরন পালটে যাওয়া এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় এবার বর্ষা মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রার্দুভাব দেখা দিচ্ছে। এ জ্বর থেকে কীভাবে নিরাপদে থাকবেন তা নিয়ে লিখেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
* ডেঙ্গু জ্বর কীভাবে হয়
এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তবে এডিস এলবপিকটাস নামক মশার কামড়েও এ রোগ ছড়াতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। আগে এডিস মশা শুধু দিনের বেলা কামড়াত। এখন সব সময় কামড়ায়।
* বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
এবারে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণের ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। জ্বরের তীব্রতা, তীব্র শরীর ব্যথা এবং র্যাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা হচ্ছে।
* চিকিৎসা পদ্ধতি
ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এ জ্বর সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়, এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত, তাই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল খেতে পারবেন, অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। প্রচুর পানি এবং তরল খাওয়ানো উচিত। খেতে না পারলে বা অন্য কোনো প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন বা গ্লুকোজ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। কিছুকিছু লক্ষণ দেখা দিলে অতিসত্বর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। যেমন-প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে, শরীরের যে কোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে, জন্ডিস দেখা দিলে, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে, প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে। এসব ক্ষেত্রে অবহেলা না করে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সবসময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে কোনো মশা কামড়াতে না পারে। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো মশা অন্য সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে এবং এভাবেই ডেঙ্গু অন্যদের মাঝে ছড়ায়।
* কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়
ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাক্সিন নেই। তাই এটি প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এ মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
* ডেঙ্গু নিয়ে জিজ্ঞাসা
▶ ডেঙ্গু জ্বরে কী কী পরীক্ষা কখন করা উচিত?
▶▶ সাধারণত বেশি টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না। সিবিসি এবং প্লাটিলেট কাউন্ট করলেই যথেষ্ট। ১-২ দিনের জ্বরে ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন এবং ৪ থেকে ৬ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু এন্টিবডি করা যেতে পারে। প্লাটিলেট কাউন্ট ৪ বা ৫ দিন পর কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর ৪-৫ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। আবার অনেকেই দিনে দুই তিনবার, এমনকি একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়।
▶ রক্ত দিতে হবে কি?
▶▶ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলেই রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে, তবে রক্ত পরিসঞ্চালন করার কোনো প্রয়োজন নেই।
▶ প্লাটিলেট কি দিতেই হবে?
▶▶ ডেঙ্গু জ্বরের ৪ বা ৫ দিন পরে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ২-৩ দিন পর তা বাড়তে শুরু করে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের কোনো প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় প্লাটিলেট একটু কমে গেলেই রোগী এবং চিকিৎসক প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়।
▶ একবার ডেঙ্গু হলে আর কি হয় না?
▶▶ ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি ভিন্ন প্রজাতি বা সেরোটাইপ আছে, তাই ৪ বার ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি প্রজাতি দ্বারা একবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভবিষ্যতে সেই সেরোটাইপ দ্বারা আর আক্রান্ত হয় না। কারণ শুধু সেই সেরোটাইপটিতে রোগীর আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু বাকি ৩টি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিকই রয়ে যায়। তবে কেউ যদি পৃথকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি প্রজাতি দ্বারা জীবনে ৪ বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি জীবনে আর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
▶ মা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে কি?
▶▶ মায়ের বুকের দুধে এ ভাইরাস থাকে না। কাজেই, আক্রান্ত অবস্থায় মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
▶ ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?
▶▶ ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে, একই তোয়ালে, একই গ্লাস কিংবা প্লেট ব্যবহার করলে অন্যদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় কোনো বাধা নেই।
▶ এন্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে কি?
▶▶ ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এতে এন্টিবায়োটিকের কোন ভূমিকা নেই। তবে ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগও থাকতে পারে, তখন এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। অনেকে মনে করেন, ডেঙ্গুতে এন্টিবায়োটিক ক্ষতি করতে পারে এবং তা পরিহার করতে হবে, যা একটি ভুল ধারণা। প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগীর কোনো ক্ষতি হবে না।
▶ গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু কী করতে হবে?
▶▶ এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই এ সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ।
* পরিশেষে
যেহেতু বর্তমান মৌসুমটা ডেঙ্গু জ্বরের আর মশার প্রকোপ এবং তার বংশবৃদ্ধি কমানো যায়নি, তাই যে কেউ এ সময়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গু জ্বরের কথা লক্ষ্য রাখতে হবে। সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা না করে, ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। জ্বর-ঠান্ডা-মাথাব্যথা দেখা দিলে দ্রুত ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়ে ফেলবেন। যত দ্রুত ধরা পড়বে, তত দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। ডেঙ্গু জ্বর হয়তো নির্মূল করা যাবে না, এর কোনো ভ্যাক্সিন কিংবা কার্যকরী ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ডেঙ্গু মশা এবং তার বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ দুটোই আমাদের চারপাশে বিদ্যমান, তাই ডেঙ্গু জ্বরকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। ডেঙ্গু আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ডেঙ্গু জ্বরকে ভয় না পেয়ে এর সঙ্গে যুদ্ধ করেই এবং একই সঙ্গে প্রতিরোধ করেই চলতে হবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।