৭ মার্চ রাতে খাবার টেবিলে বঙ্গবন্ধু
‘আমার যা বলার ছিল তা বলে ফেলেছি’
আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি অগণতান্ত্রিক ও সামরিক জান্তাশাসিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ। ভাষণটির শেষ লাইন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ইউনেস্কো ২০১৭ সালে এই ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৭ মার্চ, ১৯৭১ ভাষণ শেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বাড়িতে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে।’
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ের জামাতা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী) প্রয়াত ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯৯৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। ওয়াজেদ মিয়া মারা যান ২০০৯ সালে। এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া তার ওই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ-পরবর্তী প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ‘সেদিন থেকে এ নিয়ম (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খাওয়া) আমরা ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত পালন করেছি।’ ৭ মার্চ রাতে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে বসেছিলেন তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা, জামাতা ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, বড় ছেলে শেখ কামাল, মেজো ছেলে শেখ জামাল, ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, ছোট ছেলে শেখ রাসেল এবং নিকটাত্মীয় শেখ শহীদুল ইসলাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকসেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ-পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেন। ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ গ্রন্থে খোকা ৭ মার্চের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘সকাল থেকেই লাখো মানুষ ছুটছে রেসকোর্সের দিকে নেতার ভাষণ শুনতে, তাদের মেসাইয়া, জাতির অবিসংবাদিত নেতার কাছ থেকে তারা শুনবে আগামী দিনের কর্তব্য নির্দেশ। কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা বের করেছে। ‘মুজিব একটি নাম, মুজিব একটি ইতিহাস’ শিরোনামে বের হয়েছিল একটি পত্রিকা যার লেখা থেকে মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু আজকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ছাত্রনেতাদের দাবি ছিল অনেকটা সেই রকম। মিঞাভাইকে (বঙ্গবন্ধু) নিয়ে মঞ্চে পৌঁছার অনেক আগেই ছাত্রনেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করবেন। সেই উদ্দেশ্যে মঞ্চের পাশে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি পতাকাও রাখা হয়েছিল।’
যদিও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। কিন্তু ভাষণে যা বলেছিলেন, তা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তিনি সেই দিন এক প্রতিকূল এবং কঠিন পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। পরাধীন আট কোটি বাঙালি ওই মুহূর্তে তাদের অন্তরে যে আবেগ ও স্বপ্ন ধারণ করছিল, তারই প্রকাশ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের শেষ বাক্যে। মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে। সে দিন তার ওই ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা তার ওই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বেলা সাড়ে চারটা, মিঞাভাই দোতলা থেকে নেমে এসে উঠলেন আমার গাড়িতে, আমি চালক। পেছনে ট্রাকে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা। চিন্তামগ্ন মিঞাভাই (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। গোটা জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে তিনি আজকে কী বলবেন তার ওপর। সবার সঙ্গেই আলোচনা করেছেন, শেষ মুহূর্তে ভাবি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আপসকামিতার বিরুদ্ধে তার জীবনব্যাপী সংগ্রামের কথা। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো মিঞাভাইয়ের নিজের।’
বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১ মার্চ (১৯৭১) থেকেই বাংলাদেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ওপর দেশের মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু তারা আশা করছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একজন গণতান্ত্রিক নেতার মতোই অত্যন্ত সংযত ছিলেন। যে জন্য দেশের বাইরের জনমত ছিল তার পক্ষে।
সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, ষাটের দশকের শেষদিক থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল। নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার জন্য বায়াফ্রা সশস্ত্র সংগ্রাম করছিল। রক্তপাত হচ্ছিল কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছিল না বিদ্রোহীরা। ইন্দোনেশিয়াতেও হচ্ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সেসব আন্দোলনের নেতিবাচক দিক ও দুর্বলতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল। তিনি উপলব্ধি করেন হঠকারিতার পরিণতি শুভ হয় না এবং হঠকারী নেতা কখনো বিশ্ববাসীর সমর্থন পান না। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সংযত আচরণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ছিল তার দিকে এবং তার প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার হচ্ছিল ধিক্কৃত।