Logo
Logo
×

অপরাধ

‘দরবেশ বাবা’ সেজে সাবেক সরকারি কর্মকর্তার সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৩ এএম

‘দরবেশ বাবা’ সেজে সাবেক সরকারি কর্মকর্তার সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ

প্রতীকী ছবি

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমের (৫৯) তিন ছেলে-মেয়েই দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। স্বামী দেশের নামকরা চিকিৎসক। কর্মজীবন থেকে অবসরের পর আনোয়ারা বেশির ভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত থাকেন। এর মধ্যে তিনি কিছুটা পারিবারিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন। এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন।

এ অবস্থায় একদিন ফেসবুকের একটি বিজ্ঞাপনে তার চোখ আটকে যায়। বিজ্ঞাপনে সুন্দর সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী এক ব্যক্তি নিজেকে মসজিদে নববির ইমাম দাবি করে বলছেন, তিনি কুরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়েও সাক্ষাৎকারে বলেন, তারা এই ‘দরবেশ বাবার’ কাছ থেকে নিজেদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।

আনোয়ারা বেগম বাসার গৃহপরিচারিকার সঙ্গেও বিষয়টি আলোচনা করেন। সে তাকে জানায়, জিন-পরির মাধ্যমে ‘দরবেশ বাবারা’ এসব সমস্যার সমাধান করেন। তার গ্রামের কয়েকজনও এভাবে সমস্যার সমাধান পেয়েছেন। এ কথা শুনে আনোয়ারা বেগম উৎসাহিত হন। এরপর বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করেন। কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘দরবেশ বাবা’ তার সঙ্গে খুব সুন্দর করে কথা বলে পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। 

‘দরবেশ বাবা’ সমস্যার কথা শুনে তাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখ। আমি তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে মা, কিছু খরচ লাগবে। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও, তবে তোমার সমস্যার সমাধান হবে না। বরং তোমার সমস্যা আরও বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’

এভাবে প্রলুব্ধ করে ‘দরবেশ বাবা’ তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে বলেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ‘দরবেশ বাবা’ আনোয়ারা বেগমকে কল করে বিভিন্ন অজুহাত ও সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। 

একপর্যায়ে আনোয়ারা বেগম বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। তখন প্রতিকার চেয়ে তিনি মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। পরে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে আসামিদের শনাক্ত করে। এরপর রাজধানীর উত্তরা থেকে অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে গ্রেফতার করা হয় চক্রের মূল হোতা হাসেমকে।

সিআইডি জানিয়েছে, গ্রেফতার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এ চক্রের মূল হোতা মো. হাসেম। সে প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট অঙ্কের টাকা নিত। এরপর বড় অঙ্কের টাকা নেওয়ার সময় তানজিদ হাসানকে আনোয়ারা বেগমের কাছে পাঠাত এবং সে একসঙ্গে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেত। এভাবে ধাপে ধাপে তারা আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা নিয়েছে।

হাসেম জানিয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে সে এভাবে মানুষকে প্রতারণা করছে। প্রথমদিকে সে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। প্রতিমাসে সে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিত এবং পোস্ট বুস্ট করত। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় সে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করত। এছাড়াও সে ইউরোপের ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপনও প্রচার করত। এভাবে সে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয় দিয়ে কথা বলত ও তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিত। দরবেশ বাবা রূপি প্রতারক হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কণ্ঠে কথা বলতে দক্ষ।

সিআইডি আরও জানিয়েছে, প্রতারক হাসেম ফ্রান্স প্রবাসী মো. ইমাম হোসেনকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া আরেক ইতালি প্রবাসীর কাছ থেকে লটারি ও জুয়ায় জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা।

অনুসন্ধানে সিআইডি জেনেছে, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারকচক্রের এমন ২০ থেকে ২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে। মালয়েশিয়াতে আছে ১০ থেকে ১২ জন। এর মধ্যে ৫ থেকে ৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছেন যারা গত ৪-৫ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ রূপি প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছেন।

গ্রেফতার এ দুই প্রতারকের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে সিআইডিতে তদন্তাধীন রয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম