Logo
Logo
×

সারাদেশ

আশুলিয়ার জেবুন নেসা মসজিদ টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায়

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন, ঢাকা উত্তর

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১০:০৯ পিএম

আশুলিয়ার জেবুন নেসা মসজিদ টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায়

বিশ্বের প্রভাবশালী সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন প্রতি বছর বিশ্বের ১০০টি স্থাপনাকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০২৫ সালের তালিকায় প্রথমবারের মতো স্থান পেয়েছে সাভারের আশুলিয়ার জামগড়ার দরগারপাড় এলাকার জেবুন নেসা মসজিদ। 

বিগত  সময়ে প্রকাশিত এ তালিকার প্রতিবেদনে মসজিদটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্থপতিরা দীর্ঘদিন ধরে অত্যাধুনিক মসজিদ ডিজাইন করে আসছেন; কিন্তু ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত এই গোলাপি রঙের স্থাপনাটি তার শিল্প পরিবেশের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় চিত্র তুলে ধরে।

প্রতিবেদনে বলা হয়- ওই এলাকার অনেক টেক্সটাইল কারখানার মধ্যে একটির মালিক তার প্রয়াত মায়ের নামে নামকরণ করা জেবুন নেসা মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন, যা ৬৫০০ পোশাক শ্রমিকের জন্য অবকাশ হিসেবে (নামাজের পাশাপাশি) কাজ করে।

আশুলিয়ার দরগার পাড় এলাকায় আইডিএস গ্রুপের ফ্যাশন ফোরাম লিমিটেড কারখানার অভ্যন্তরে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন জেবুন নেসা মসজিদ। চতুর্ভুজ আকৃতির অবকাঠামোর মাঝে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি গম্বুজ। প্রাকৃতিক আলো বাতাস প্রবেশের জন্য পুরো মসজিদের দেয়ালজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র, যা মসজিদটিকে করেছে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত। মসজিদের সামনে রয়েছে কাঁচে ঘেরা একটি সরু লেক। এই লেকের পানির মাধ্যমে বাতাস প্রাকৃতিকভাবে শীতল হয়ে প্রবেশ করে মসজিদে। এ কারণেই মসজিদটিতে লাগানোর প্রয়োজন হয়নি এসি কিংবা বৈদ্যুতিক পাখা। 

স্টুডিও মরফোজেনেসিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সায়কা ইকবাল মেঘনা বলেন, একজন নারীর নামে নামকরণ থেকেই আমি এমন একটি স্থাপনা নির্মাণের ধারণা পাই, যেটি পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি সফট শেল্টারও (বিকল্প আশ্রয়স্থল) হতে পারে।

তিনি বলেন, এ জায়গাটি সব পোশাক শ্রমিকের জন্য হওয়া উচিত। একজন স্থপতি হিসেবে এটি একটি বড় অর্জন।

ঢাকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্টুডিও মরফোজেনেসিসের অন্যতম পরিচালক সাইকা ইকবাল মেঘনা জেবুন নেসা মসজিদের প্রধান স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে পড়াশোনা করেছেন এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায়ও যুক্ত রয়েছেন। মসজিদের জমিদাতা নিজের প্রয়াত মা জেবুন নেসার নামেই এর নামকরণ করেন।

মেঘনা বলেন, একটি ছায়াঘেরা পুকুরের পাড়ে গোলাপি ইটের বুননে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনব নকশার এই মসজিদ যেকোনো দর্শকেরই দৃষ্টি কাড়ে। মসজিদের ভেতর-বাইরের পরিবেশ এতই চমৎকার ও প্রাকৃতিক যে এ এলাকার শ্রমিক, পথচারী ও মুসল্লিদের দুদণ্ড প্রশান্তির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

নকশাকারদের মতে, মসজিদটি সমতল থেকে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। বৃষ্টির মৌসুমে ভারি বর্ষণ হলে যেন তা উপচে পড়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ না করে, সে জন্যই প্রচলিত এই শৈলী গ্রহণ করা হয়েছে। আশপাশের ভারি শিল্প এলাকার কঠোরতা থেকে কোমলতার দিকে আনতেই মসজিদের গায়ে গোলাপি রং ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধুলোময় গোলাপি আভা ঐতিহাসিক মোগল, সুলতানি ও ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যে ব্যবহৃত লাল-গোলাপি মাটির প্রতিনিধিত্ব করে।

 জেবুন নেসা মসজিদের সামনের আলোহীন আবদ্ধ মিহরাবের প্রচলিত নকশার বিপরীতে এই মসজিদে রয়েছে ব্যতিক্রমী এক খোলা মিহরাব। সামনে রয়েছে স্বচ্ছ পানির কৃত্রিম জলাধার। এরপর রয়েছে বড় প্রাকৃতিক পুকুর। প্রশস্ত খোলা খিলান দিয়ে মুসল্লিরা সামনের জলাশয় ও পুকুরটি স্পষ্ট দেখতে পান। অবশ্য বাতাসের সরাসরি ক্ষতিকর প্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে জলাশয়ের পর পুকুরপাড়ে মসজিদের সামনের খিলানের সমপরিমাণ কাচ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

জেবুন নেসা মসজিদ যেন মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার এক নিরাপদ আস্তানা। স্থপতিদের ভাষায় এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রেদিং প্যাভিলিয়ন’। মসজিদের চারপাশের দেয়ালগুলোতে রয়েছে অসংখ্য আয়তাকার ছিদ্র, যা দিয়ে আলো-বাতাস প্রবাহিত হয়। এ সব ছিদ্র প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যের আদলে মসজিদের ভেতরে আলোর মায়াজাল বোনে। ছোট ছোট ছিদ্রের মধ্য দিয়ে পরিশোধিত আলোর মিছিল যেন মসজিদের ভেতরে ঝাড়বাতির আবহ তৈরি করে।

প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের জন্য মসজিদের সামনে-পেছনে আধখোলা কাঠামো রয়েছে, যা একই সঙ্গে সূর্যের সরাসরি আলো ও বৃষ্টি থেকে নিস্তার দেয়। ভেতরের কাঠামো গোলাকার হয়ে ওপরে উঠে বিশালাকার অগভীর গম্বুজ তৈরি করেছে। মাঝখানে কোনো স্তম্ভ নেই। গম্বুজের বাইরের চারপাশে কিছুটা ফাঁকা রেখে গড়ে ওঠা হালকা বাঁকানো ছিদ্রযুক্ত চারদেয়াল মসজিদের নকশাকে নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব করে তুলেছে। মসজিদের সামনে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ।

পূর্বপাশে বাইরে একটি ইস্পাতের সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ির ওপরে অর্ধচাঁদ আকারের একটি ফ্লোর তৈরি করা হয়েছে, যেখান থেকে সরাসরি নিচতলার ইমাম ও মুসল্লিদের স্থান দেখা যায়। মেজ্জানাইন নামের এই স্থান নারীদের নামাজের জন্য বরাদ্দ। স্থপতি সাইকা ইকবাল মেঘনার মা নামে এই মসজিদে নারীদেরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন নারী হিসেবে এই মসজিদের নকশা করতে পেরে তিনি গর্বিত।

লাল সিমেন্ট ও ভাঙা ইটের টুকরোয় তৈরি হয়েছে খানিক প্রসারিত বাইরের মেঝেটি। সেখানে এক পাশে রয়েছে স্বচ্ছতা ও পবিত্রতার প্রতীক ফিরোজা মোজাইকে তৈরি অজুখানা। কিছুটা নিচু আলাদা ছাদে নির্মিত হয়েছে অজুখানাটি, যেখান থেকে পাশের বড় পুকুরটি স্পষ্ট দেখা যায়। পূর্ব পাশের মাটির উঠোনে গজাচ্ছে সবুজ ঘাস। সব মিলিয়ে জেবুন নেসা মসজিদের নকশা দুর্দান্ত বলা যায়। এ যেন প্রকৃতির মাঝে বসে স্রষ্টার কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ার সেরা আয়োজন। 

মসজিদের মুসল্লিরা বলছেন, শুধু এই এলাকাতেই নয়, সারা দেশের মধ্যে এরকম নকশার মসজিদ একটাই। গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ শ্রমিকসহ সবার নামাজের জন্য এত সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণ করায় তারা কৃতজ্ঞ। অনেক গরমের মধ্যেও ফ্যান ছাড়াই এই মসজিদে শীতল পরিবেশে নামাজ আদায় করেন তারা। পবিত্রতার প্রতীক ফিরোজা কালারের টাইলস দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন অজুখানা। এছাড়া সুন্দর ব্যবস্থাপনায় এই মসজিদের মনোরম পরিবেশে নামাজ পড়তে পেরে খুশি গার্মেন্টস শ্রমিক নারী মুসল্লিরাও। 

মসজিদের ইমাম হাফেজ মুফতি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সারাদিন গার্মেন্টসের ভেতরে কাজ শেষে বিরতির সময় মসজিদের মনোরম পরিবেশে নামাজ আদায় করলে শ্রমিকদের মন প্রফুল্ল থাকে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে এত সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন, যা দৃষ্টান্ত। এখন এ মসজিদের পরিচিতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম