আ.লীগ পতনের পর গাজীপুরে শ্রমিকদের ৮৪ বার সড়ক অবরোধ

মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, গাজীপুর
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:২১ পিএম

শিল্পনগরী গাজীপুরে শ্রমিকদের পাওনাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন যেন থামছেই না। প্রতিদিন জেলার কোথাও না কোথাও শ্রমিক আন্দোলন লেগেই আছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গাজীপুরে অন্তত ৮৪ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দিন পরপর অবরোধের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব পথে চলাচলকারী হাজারও যানবাহনের যাত্রীরা।
সর্বশেষ গাজীপুর নগরের তেলিপাড়া এলাকায় ঈদ বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে স্মাগ সোয়েটার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সকাল ৯টা থেকে টানা তিন ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ ও থানা পুলিশের সহযোগিতায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ওই সময় শ্রমিক আন্দোলনের কারণে আশপাশের ৫-৬টি কারখানা কর্তৃপক্ষ অনভিপ্রেত ঘটনা এরাতে তাদের কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেন।
ওই কারখানার শ্রমিক আলতাফ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন মহাসড়ক আটকে রেখেছেন। এর জবাবে আলতাফ হোসেন বলেন, আমাগো দেশে যদি ভদ্রভাবে কোনো কথা কন তাইলে কেউ হোনব না। কথা হোনার মানুষও পাইবেন না। স্যারেগো বারবার কয়তাছি আমাগো সমস্যা সমাধান করেন। ঈদ বোনাস বাড়াইয়া দেন কিন্তু তারা কইতাছে দিবো না। যার কারণে সড়ক বন্ধ কইরা আন্দোলন করতাছি। এহন সরকারের লোকজন আইবো তখন ঠিকই আমাগো সমস্যা সামাধান হইয়া যাইবো।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সদস্য মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, শ্রমিকদের কোনো সমস্যা থাকলে তারা বিজিএমইএতে যেতে পারে। সেখানে সবার কথা বলার একটা জায়গা আছে। তারা সেখানে আলোচনা না করে যখন তখন সড়ক মহাসড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করলে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই শিল্পকে ধ্বংস করতে নানা ধরনের চক্রান্ত করা হচ্ছে তার জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কথায় কথায় রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত ৭ মাসে অন্তত ৮৪ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ,ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। অবরোধ ছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময়ে জেলায় অন্তত শতাধিক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করেছে মহানগরীর জিরানী সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা। গত ১৬ ডিসেম্বর ওই পার্কের ১৬টি কারখানা একযোগে বন্ধ (লে-অফ) ঘোষণা করা হয়। বন্ধের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কারখানাগুলোতে অর্ডার না থাকা ও কারখানার নামে ব্যাংকে পর্যাপ্ত ঋণখেলাপি থাকায় আর পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বেক্সিমকো টেক্সটাইল লিমিটেড ও গার্মেন্টসের ১৬টি প্রতিষ্ঠানে ১৬ ডিসেম্বর থেকে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক বন্ধ থাকবে বলে নোটিশে জানায়।
এরপর ১৭ ডিসেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময়ে শ্রমিক চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। সেদিন থেকে টানা ৬ দিন ওই মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে শ্রমিকরা। বেতন পেয়ে ৬ দিন পর শ্রমিকরা মহাসড়ক থেকে সরে যায়।
শিল্প পুলিশ ও কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথো বলে জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার গ্লোবাস অ্যাপারেলস লিমিটেড ও একই মালিকানাধীন আগামী ওয়াশিং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে। বেতনের দাবিতে টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায় বিএইচআইএস অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা। জিরানী এলাকার রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ও আইরিশ ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল ও নাইট বিল বৃদ্ধির দাবিতে অন্তত চার দিন চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এসব এলাকায় শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবিদাওয়া মেনে নিলে পরিবেশ শান্ত হয়।
অপরদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন কোনাবাড়ী ইসলাম গার্মেন্টস লিমিটেড, রেজাউল অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন সুমিট লিমিটেড, কেএম নোভেলি লিমিটেড, স্বাধীন ফ্যাশন, ফ্যাশন পয়েন্ট, লাইফট্যাক্স লিমিটেড, কানিজ ফ্যাশন, এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড, পিএন কম্পোজিট, মুকুল নিটওয়্যার, কটন ক্লাব, এ্যামা সিনট্যাক্স, বেসিক ক্লোথিং ও অ্যাপারেল প্লাসের শ্রমিকেরা। চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিনস ও নূরুল স্পিনিং কারখানার শ্রমিকেরাও বিক্ষোভ করেছেন সড়ক অবরোধ করে। এছাড়া পানিশাইল এলাকার ডরিন ফ্যাশন, চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস,নূরুল ইসলাম স্পিনিংয়ের শ্রমিকেরা নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন।
অবরোধের কারণে প্রায়ই দুর্ভোগে পড়ছেন গাজীপুরের ভিআইপি পরিবহণের চালক কবির হোসেন। তিনি বলেন, শ্রমিকরা যদি আন্দোলন করে সড়ক অবরোধ ও যানবাহন ভাঙচুর করে তবে এখন থেকে পরিবহণ শ্রমিকরাও আন্দোলন করবে। কারখানা শ্রমিকদের প্রতিহত করা হবে। তারাও শ্রমিক আমরাও শ্রমিক। তাদের দাবি থাকলে কারখানায় আন্দোলন করবে আমাদের রাস্তায় কেন আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আপনার কষ্টটা আমি তখনই ফিল করতে পারব যখন আপনি আমাকে কিছু কষ্ট দিতে পারবেন। তারা বেতন না পেয়ে অভুক্ত আছে সে রাস্তা ব্যারিকেড দিলে শত শত মানুষ কষ্ট পাচ্ছে এটার জন্য শত শত মানুষ তাদের পক্ষে দাঁড়াবে। সেই চিন্তা থেকেই তারা মহাসড়ক অবরোধ করছে, পাশের কারখানায় হামলা চালাচ্ছে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা মনে করে বিজিএমইএ কলকারখানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে তারা দ্রুত সমস্যার সমাধান পাবে না। যার কারণে বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে তারা হুটহাট রাস্তা বন্ধ করে অবরোধ করছে। তারা মনে করে রাস্তা অবরোধ করলে প্রশাসন আসবে এবং দ্রুত তাদের সমস্যার সমাধান করে দিবে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সমাধানও পাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হলে প্রতিটি কারখানা শ্রমিকদের সংগঠন করতে হবে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার একেএম জহিরুল ইসলাম বলেন, রাস্তা অবরোধ ছাড়া আর কোনো খুব বেশি বিকল্প তাদের কাছে নেই যেটা দ্রুত রেসপন্স করে। রাস্তা অবরোধের ফলে সকলে রেসপন্স দ্রুত পাওয়া যায়। রাস্তায় আটকা পড়াদের মধ্যে চাকরিজীবী থাকে,ব্যবসায়ী থাকে, বিদেশগামীরা থাকে, মোটর শ্রমিকরা থাকে। তখন তারা সবাই শ্রমিকদের পক্ষ নেয় এবং তাদের পক্ষে এক জনমত তৈরি হয়। তখন পুলিশ, কলকারখানা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। তারা চিন্তা করে এগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। আবার অনেক সময় তারা প্রত্যাশিত সমাধান পাচ্ছেও।