টাকা দিলেই ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির তালিকায় বসান এই কর্মকর্তা

যুগান্তর প্রতিবেদন, আমতলী (বরগুনা)
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম

বরগুনার আমতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. অলি আহাদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে নামসর্বস্ব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তি করতে তালিকা প্রেরণের অভিযোগ উঠেছে।
কাগজে-কলমে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী আছে কিন্তু বাস্তবে শিক্ষার্থী নেই। অধিকাংশ মাদ্রাসায় ঘর নেই, যা আছে তা জরাজীর্ণ। অভিযোগ রয়েছে নাম সর্বস্ব এ সকল স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির ঘোষণার পর থেকে আমতলী-তালতলীতে দালাল চক্র মাদ্রাসা প্রতি ১০ লাখ টাকা আদায় করছেন। দালাল মাওলানা আলাউদ্দিন ও জালাল পিয়াদাসহ ১০ দালালচক্রের ফাঁদে পরে চাকরি এমপিওভুক্তির লোভে মাদ্রাসার শিক্ষকরা টাকা দিচ্ছেন।এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সচেতন মহলের।
জানা গেছে, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ১১৯টি নাম সর্বস্ব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার তালিকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অলি আহাদ বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসে প্রেরণ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে অর্থের বিনিময়ে দালাল চক্রের যোগসাজশে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অলি আহাদ এ তালিকা তৈরি করেছেন। আমতলীর ৭৬টি ও তালতলীর ৪৩টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এর মধ্যে দুই উপজেলায় অনুদানভুক্ত স্বতন্ত্র মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র ছয়টি।
এ মাদ্রাসাগুলো হলো- পুর্ব চিলা হাসানিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, উত্তর ঘোপখালী, মোহাম্মদপুর (নাচনাপাড়া) মাহমুদিয়া, কুতুবপুর ইসরাইলিয়া ও তালতলীর চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসা ছয়টি অনুদান পেলেও গত দুই এক বছরে কোনো শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় আনেনি।
শিক্ষকরা কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী দেখিয়ে আসছেন। বাস্তবে কোনো শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরা মাঝে মধ্যে মাদ্রাসায় আসলেও উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করে খাতা নিয়ে করে চলে যান। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন এ সকল মাদ্রাসায় কোন দিন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আসতে দেখিনি। ঘর সবসময়ই তালাবদ্ধ থাকে। ঘর আছে, তাও জরাজীর্ণ। এছাড়া অনুদানবিহীন ১১৩ মাদ্রাসার মধ্যে অধিকাংশ মাদ্রাসারই অস্তিত্ব নেই, শিক্ষার্থী তো দুরের কথা। ২০১৮ সালে ওই সকল মাদ্রাসার ঘর তুলে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে এসব মাদ্রাসার নামে কাগজে কলমে শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। আমতলীর ৭৬টি মাদ্রাসায় ৯ হাজার ৭৫০ জন শিক্ষার্থী এবং তালতলীর ৪৩টি মাদ্রাসায় ৫ হাজার ৯৫০ জন শিক্ষার্থী; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে দুই একটি মাদ্রাসা ছাড়া কোনো মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নেই।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস কর্তৃপক্ষ আমতলী ও তালতলীতে নামসর্বস্ব মাদ্রাসার তালিকা বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসে প্রেরণ করেছেন। গত ২৮ জানুয়ারি অর্ন্তবর্তী সরকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ঘোষণা দিলে উৎসবে মেতে উঠে আমতলী-তালতলীর একাধিক দালাল চক্র। তারা মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির নামে প্রত্যেক মাদ্রাসাপ্রতি ১০ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
দালালদের বক্তব্য দ্রুত টাকা দেন, নইলে মাদ্রাসা জাতীয়করণের তালিকায় নাম যাবে না। যারা আগে টাকা দিবে তাদেরটা আগের তালিকায় এমপিওভুক্তি হবে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টাকা দিতে হবে। নইলে এমপিওভুক্তি হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে দালালরা মাদ্রাসাপ্রতি ১০-১৫ লাখ টাকা চাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দালালদের টাকাও দিয়েছেন।
বুধবার আমতলী উপজেলার অনুদানভুক্ত মাদ্রাসা কুতুবপুর ইসরালিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, মোহাম্মদপুর মাহমুদিয়া ও তালতলী উপজেলার একমাত্র চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেছে, মাদ্রাসার ঘর আছে; কিন্তু কতদিন আগে এ মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী এসেছে তা বলা মুশকিল।
কুতুবপুর ইসরাইলিয়া স্বতন্ত্র মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান গোলাম কিবরিয়া বলেন, এখনো বই পাইনি। তাই ক্লাস করতে পারছি না। অনুদানবিহীন তালিকার ৪০ নম্বর গোজখালী তাছাউফ স্বতন্ত্র মাদ্রাসার কোন ভবন নেই। স্থানীয় নুর জামাল, সফিকুল্লাহ ও আবিদ বলেন, ভবনতো নেই, শিক্ষার্থীও নেই। কিন্তু কিভাবে তালিকায় নাম আসলো তা আমরা জানি না?
তালিকায় ২৯নং চরখালী স্বতন্ত্র মাদ্রাসায় ভবন আছে। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী নেই। স্থানীয় আব্দুর রব, অলি উল্লাহ, মোহাদ উল্লাহ, রাবেয়া ও নাসিমা বেগম বলেন, ৫ বছর আগে খালের পাড়ে মাদ্রাসা ঘর নির্মাণ করেছেন রাজ্জাক মৃধা। কিন্তু কোন দিন কোন শিক্ষার্থী আসেনি। এখন শুনছি আবার চালু হবে।
৬৫নং হাট চুনাখালী স্বতন্ত্র মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় মোস্তফা মাদবর বলেন, ইঞ্জিনিয়ার ইলিয়াস মিয়া এ মাদ্রাসা করেছেন। কিন্তু ভবন ও শিক্ষার্থী কিছুই নেই। ৭৬নং পশ্চিম কেওয়াবুনিয়া মুজাহিদিয়া, ১৪নং উত্তর কাউনিয়া, ৫৩নং কাউনিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই।
স্থানীয়রা বলেন, গত ২০ বছরে দেখি নাই এই নামে কোনো মাদ্রাসার অস্বিত্ব আছে। তালতলীর ২৫নং পূর্ব গাবতলী এইউ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই। জাতীয়করণ ঘোষণার পরে মাদ্রাসার নাম তালিকায় দিয়েছেন।
দালাল জালাল পিয়াদার মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আমতলী উপজেলা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আলাউদ্দিন টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাদ্রাসার তালিকা চেয়েছেন তাই তালিকা দিয়েছি।
শিক্ষার্থী নেই এমন মাদ্রাসার নাম দিলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
আমতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক মাদ্রাসার অস্তিত্ব নেই। তারপরও বিভিন্ন চাপে পড়ে তালিকা করতে হচ্ছে।
আমতলী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অলি আহাদ দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তালিকা প্রস্তুতের কথা অস্বীকার করে বলেন, মাদ্রাসা অধিদপ্তরের প্রেরিত চিঠির আলোকে তালিকা করা হয়েছে।
বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, মন্ত্রণালয় তালিকা চেয়েছে তাই তালিকা পাঠানো হয়েছে; কিন্তু নামসর্বস্ব মাদ্রাসার নাম কেন তালিকায় পাঠিয়েছেন? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।
তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে সালমা বলেন, অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, তালিকায় অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।