সরকারি কলেজের ৫০ কোটি টাকার হিসাব না দিয়ে লাপাত্তা আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ

মোরশেদ আলম, গাজীপুর
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কলেজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র নিয়ে উধাও হয়েছেন শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুন্নবী আকন্দ। তার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের একাধিক মামলা হয়েছে শ্রীপুর থানায়।
নুরুন্নবী উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বছরের ২৮ মার্চ কলেজের অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেনকে জোরপূর্বক মারধর করে কলেজ থেকে বিতাড়িত করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন তিনি। পরে বিতাড়িত তোফাজ্জল হোসেন কলেজে ফিরতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও নুরুন্নবী তাকে কলেজে ফিরতে দেননি।
এরপর থেকে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি করার অপরাধে কয়েকজন শিক্ষকের ওপর অত্যাচার করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অধ্যক্ষ নুরুন্নবী কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২০১১ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষের পদ দখল করেন, এরপর শুরু হয় তার নোংরা কর্মযজ্ঞ। যার মধ্যে অন্যতম অভিযোগ ছিল ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। আওয়ামী লীগের ১৫ বছর তার হাতেই ছিল কলেজের একচ্ছত্র আধিপত্য।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে তার নিজস্ব কথিত নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে স্ত্রী, ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগিনা, ভাগিনী, ভাই, উকিল কন্যা, উকিল জামাতা বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনসহ ৮৭ জনকে অনৈতিক দাবি মিটিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য চালিয়েছেন।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারিকরণের ঘোষণা দেওয়ার পর কৌশলে নুরুন্নবী আকন্দ শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজের নাম পরিবর্তন করে তৎকালীন সংসদ সদস্য রহমত আলীর নামে নামকরণ করে বিশেষ সুবিধা নেন। তৎকালীন সংসদ সদস্যের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন নুরুন্নবী। শিক্ষকতার বাহিরে জমি দখলসহ নানা অনিয়মে জড়িত ছিলেন। শ্রীপুর কলেজকে সরকারি কলেজ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর নুরুন্নবী উকিল কন্যা (বাংলা) আফরোজা আক্তার, ভাগিনা (হিসাব বিজ্ঞান) সোহরাব হোসেন, ভাগিনা (সমাজ কর্ম) নজরুল ইসলাম ও (ব্যবস্থাপনা) হুমায়ুন কবির ও আপন ভাতিজা বাবুকে লাইব্রিয়ান পদে জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে এমপিওভুক্ত করেন।
দুদকে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুরুন্নবী আকন্দ ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার মধ্যে ২০২৩ সালে বিভিন্ন ভাউচারের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি টাকার দুর্নীতি এবং ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি ৪৪ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা কলেজ ফান্ড থেকে আত্মসাৎ করেছেন।
গত জুলাই থেকে অত্র কলেজের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ রেজুলেশন বই আয়-ব্যয়ের হিসাব ও ক্যাশ খাতাসহ লাপাত্তা হয়ে আছেন।
কলেজের শিক্ষকরা জানান, পলাতক উপাধ্যক্ষ নুরুন্নবী আকন্দ শ্রীপুর কলেজকে সরকারি কলেজ হিসেবে (GO) ঘোষণা দেওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের খরচের কথা বলে তিন দফা প্রতিবার প্রতি শিক্ষকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ করে টাকা নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপাধ্যক্ষ নুরুন্নবী আকন্দের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় তিনি ও তার স্ত্রী ঢাকায় আত্মগোপনে আছেন।
উপরোক্ত বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর পিয়ারা নার্গিস জানান, নুরুন্নবী আকন্দ ২২ জুলাই-২০২৪ এরপর থেকে কলেজের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র সঙ্গে নিয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। তাকে এ যাবৎ ৬টি কারণ দর্শানোর লিখিত নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন মাধ্যমে ও বিভিন্ন সরকারি দফতরে সাবমিট করা কাগজ মূলে এবং সাবেক শ্রীপুর কলেজের ক্ষমতার অপপ্রয়োগে অপসারিত অধ্যক্ষ মো. তোফাজ্জল হোসেনের মামলার ফলাফলে আদালতের আদেশ মতে জানা যায়, নুরুন্নবী আকন্দের নিয়োগ প্রমোশন ও সকল কর্মকাণ্ড অবৈধ। তিনি তহবিলে ৫০ কোটি টাকার হিসাব না দিয়েই পলাতক রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, অনেক নিয়োগ স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অনৈতিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনেক নিয়োগ পরিবারের যোগ্যতাহীন লোকজনকে দিয়েছেন। এছাড়াও নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির কয়েক ডজন অভিযোগ রয়েছে। এগুলো সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বিভিন্ন সময়ে তদন্ত করছে।