মামলার আসামিকে অধ্যক্ষ পদে বসালেন ইউএনও

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

একক ক্ষমতায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে স্বপদে বহাল করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। যদিও তিনি অন্তত পাঁচটি ফৌজদারি মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও জমা হয়েছে।
জানা গেছে, পদাধিকার বলে ইউএনও রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি। গত বছর ইউএনও এ কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট করান।
এতে উঠে আসে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত কলেজের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন সেলিম রেজা। তবুও তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে তাকেই স্বপদে ফেরালেন ইউএনও। এ নিয়ে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
কলেজের শিক্ষক কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা অভিযোগে বলেন, সেলিম রেজা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। তবে ২০২২ সালের জুলাইয়ে সাবেক এমপির নারীঘটিত বিষয়ে কথা বলার জেরে এলাকার তৎকালীন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে হকিস্টিক দিয়ে বেদম পিটিয়েছিলেন। ফলে দেশব্যাপী আলোচনায় এসেছিলেন সেলিম রেজা। তখন মার খেয়েও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। তবে এখন তিনি বলছেন, ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে ঠিকই পিটিয়েছিলেন।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের বেতনের টাকায় ভাগ বসানো, নিয়োগ বাণিজ্যসহ কলেজের আয়ের বিপুল টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে সেলিম রেজার বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের আমলেই তার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়। কিন্তু এরপর ১৮ মাসেও তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে তিনি আর কলেজে যাননি। পরে ৫ আগস্ট থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ছুটি দেখান।
এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (মাউশি) তদন্ত করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়মের সত্যতা পায়। এজন্য গত বছরের মার্চ থেকে তার বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গত ২২ সেপ্টেম্বর সেলিম রেজা কলেজে ফিরলে ৫ নভেম্বর কলেজের ৩২ জন শিক্ষক তাকে বরখাস্তের জন্য কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও ইউএনও আবুল হায়াতের কাছে আবেদন করেন। তখন ইউএনও আবুল হায়াত তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। আর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয় কলেজের শিক্ষক হাসিনা পারভীনকে। পরে কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিটের জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি করে দেন ইউএনও।
এই কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন সহকারী অধ্যাপক নিরেন্দ্রনাথ সাহা। অন্য পাঁচ সদস্য হলেন- সহকারী অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, আব্দুস সবুর, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সুলতানুল ইসলাম, প্রভাষক শামীম হোসেন, আব্দুস সামাদ ও পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম।
গত ১৫ ডিসেম্বর এই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন অধ্যক্ষ সেলিম রেজা।
তবে এরই মধ্যে স্বপদে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠেন সেলিম রেজা। তিনি স্বপদে ফেরার জন্য গভর্নিং বডির সভাপতি ও ইউএনও আবুল হায়াতের কাছে সম্প্রতি আবেদন করেন। ইউএনও এ ব্যাপারে গত ২৮ জানুয়ারি তার কার্যালয়ে গভর্নিং বডির সভা ডাকেন।
সভাপতির ডাকে সেখানে যান গভর্নিং বডির সদস্য সচিব হাসিনা পারভীন, শিক্ষক প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নুমায়ন আলী।
ওই সভায় ইউএনও সেলীম রেজাকে স্বপদে বহাল করার প্রস্তাব দেন। এ সময় কমিটির অন্য তিন সদস্য এর বিরোধিতা করেন। তারপরও ইউএনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন এবং একটি কার্যবিবরণী তৈরি করে একাই স্বাক্ষর করেন। কার্যবিবরণীতে অন্য কেউ স্বাক্ষর করেননি।
গভর্নিং বডির সদস্য সচিব হাসিনা পারভীন বলেন, ইউএনও সেলিম রেজাকে বহাল করার প্রস্তাব দিলে আমি বলি যে, ৩২ জন শিক্ষক তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার আবেদন করেছিলেন; এখন তাদের কী হবে? সেলিম রেজা তো ফিরেই প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করবেন। কিন্তু ইউএনও কথা না শুনে বললেন তাকে স্বপদে ফেরানোর জন্য দলীয় অনেক চাপ আসছে। ওপর থেকে সুপারিশ আসছে। ইউএনও নিজেই বললেন, সেলিম রেজার স্ত্রী নাকি তার বাসায় চলে যাচ্ছেন। এখন শুনছি যে, সেলিম রেজার বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলায়। ইউএনও স্যারের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায়। পাশাপাশি এলাকা। আত্মীয়-স্বজন দিয়েও নাকি ইউএনওকে ধরা হয়েছে। দুজনেই আওয়ামীপন্থি মানুষ। তিনি কেন এটা করলেন জানি না।
হাসিনা পারভীন আরও বলেন, গভর্নিং বডি চার সদস্যের। আমরা তিনজন কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করিনি। সভাপতি হিসেবে ইউএনও একাই স্বাক্ষর করেছেন। একক কারও স্বাক্ষরে তো কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। তাই ইউএনওর তৈরি করা কার্যবিবরণী অবশ্যই অবৈধ। আমরা এটি মানি না।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইউএনও আবুল হায়াতকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
ইউএনওর স্বাক্ষর করা কার্যবিবরণীতে লেখা হয়েছে- কলেজের আরও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে। মামলার কারণে অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হলে অন্যদেরও বরখাস্ত করতে হবে। এতে কলেজের পাঠদান ব্যাহত হবে। তাই মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই বরখাস্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন ইউএনও।
যদিও ইউএনওর এমন সিদ্ধান্তকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবেই দেখছেন কলেজের শিক্ষকরা। এমন স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক হাসিনা পারভীন গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
তবে চারদিনেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নুমায়ন আলী। তারা বলেন, সভাপতি হিসেবে ইউএনও একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন, এটা হতে পারে না।
এদিকে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। অডিট রিপোর্টে ৩৫ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, এ রিপোর্টও যথাযথ নয়।
তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হলে গভর্নিং বডি একান্ত প্রয়োজন মনে করলে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারেন- এমন বিধান আছে। সভাপতি একান্ত প্রয়োজন মনে করেননি বলে তাকে বহাল করেছেন।