দিনাজপুরে ওএমএসের চাল পাচার, কমছে না দাম

দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২১ পিএম

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য বিভাগের খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি কর্মসূচি চালু থাকলেও ধানের জেলা দিনাজপুরে কমছে না চালের দাম।
দিনাজপুর জেলায় খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৩৬ জন ডিলারের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে প্রতি দিন ৪৮ টন চাল এবং ২৪ টাকা কেজি দরে ১২ টন আটা বিক্রির কথা বলা হলেও এর প্রভাব পড়ছে না বাজারে। সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। সরকারের এ কর্মসূচির পরও সেই বাড়তি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
অভিযোগ রয়েছে, ওএমএস কর্মসূচির মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা খাদ্য বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কতিপয় অসাধু ডিলারের যোগসাজশে সরকারি এসব খাদ্যপণ্য পাচার করে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে বা ব্যবসায়ীর কাছে। এ কারণেই বাজারে কমছে না চালের দাম।
এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) খাদ্য বিভাগের এক অভিযানে। ওএমএসের এসব খাদ্যপণ্য সরকারি বস্তা বদল করে বাজারে অবৈধভাবে বিক্রির প্রস্তুতিকালে সোমবার ৫১ বস্তা (১৫৪০ কেজি) চাল এবং ১৯ বস্তা (৯৫০ কেজি) আটা উদ্ধার করেছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের একটি অভিযানিক দল।
দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী বলেন, আমাদের সোমবার সকালে একটি গোপন সংবাদ আসে যে, একজন ব্যাক্তি ওএমএস ডিলারের কাছ থেকে গোপনে বা চুরি করে চালের বস্তা বা আটার বস্তা কিনে নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে মজুত করে বিক্রি করার চেষ্টা করে।
এরকম আমাদের খাদ্য বিভাগের একটি টিম স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে যায় এবং দিনাজপুর শহরের পাটুয়াপাড়া এলাকায় জনৈক রানা নামে এক ব্যক্তির বাসায় ১৯ বস্তা আটা ও ৫১ বস্তা চাল দেখতে পায়। কিছু চাল এবং কিছু আটা সরকারি বস্তায় ছিলো এবং বাকি চাল ও আটা সরকারি বস্তায় খুলে প্রাইভেট বস্তায় প্যাকেটজাত করা হচ্ছিল।
অভিযুক্ত রানা আমাদের টিম যাওয়ার আগেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারেনি।
এজন্য পরবর্তীতে ৫১ বস্তা চাল এবং ১৯ বস্তা আটা সেখান থেকে জব্দ করে কোতোয়ালি থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং রানার নামে খাদ্যদ্রব্য স্থানান্তর, মজুত ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২৩ অনুযায়ী নিয়মিত মামলা করা হয়েছে।
এদিকে দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে দিনাজপুরে খোলাবাজারে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও ২৪ টাকা কেজি দরে আটা বিক্রি কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। দিনাজপুর শহরে ১২ জন ডিলারের মাধ্যমে প্রতিদিন ১ টন করে মোট ১২ টন চাল এবং ১ টন করে ১২ টন আটা খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
এছাড়া গত ১৫ জানুয়ারি থেকে দিনাজপুর জেলার অন্য ১২টি উপজেলায় মোট ২৪ জন ডিলারের মাধ্যমে দেড় টন করে মোট ৩৬ টন চাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এ হিসাবে দিনাজপুর জেলায় ৩০ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন ৪৮ টন চাল ও ২৪ টাকা কেজি দরে ১২ টন আটা বিক্রি করা হচ্ছে।
খাদ্য বিভাগের এই ওএমএস কর্মসূচির পরও দিনাজপুরে বাজারে কমছে না চালের দাম। সেই বাড়তি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। দিনাজপুর শহরের প্রধান চালের বাজার বাহাদুরবাজার এনএ মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি কেজি গুটি স্বর্ণ চাল ৫০ টাকা, সুমন স্বর্ণ ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা, বিআর-২৯ জাতের চাল ৬৭ থেকে ৬৮ টাকা, মিনিকেট ৭৬ থেকে ৭৭ টাকা এবং প্রতিকেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা দরে।
বাহাদুরবাজার এনএ মার্কেটের চাল বিক্রেতা লিয়াকত আলী জানান, আগের সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে চাল। খাদ্য বিভাগের খোলাবাজারে চাল বিক্রির কোন প্রভাব পড়েনি। তবে ভারত থেকে এলসির চাল আমদানি হওয়ায় গত ১৫ দিন ধরে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে, কিন্তু দাম কমেনি।
খাদ্য বিভাগের ওএমএস কর্মসূচি চালু থাকার পরও বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসার ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাল বিক্রেতারা জানান, খাদ্য বিভাগের এই ওএমএস কর্মসূচি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে মিল মালিকরা চালের দাম কমাতে বাধ্য হতো। মিল মালিকদের কাছ থেকে বাড়তি দামে চাল কিনে বাধ্য হয়ে বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, দিনাজপুর জেলায় ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন ৪৮ টন চাল এবং শহরে ২৪ টাকা কেজি দরে ১২ টন আটা বিক্রির কথা থাকলেও তা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না।
এসব চাল ও আটা বিক্রি কার্যক্রম মনিটরিং-এর জন্য দিনাজপুর জেলার ৩৬ জন ডিলারের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের একজন করে মোট ৩৬ জন মনিটরিং কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এরপরও ডিলারের কাছ থেকে সরকারি এসব চাল ও আটা পাচার হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। খাদ্য বিভাগের কতিপয় অসাধু মনিটরিং কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কতিপয় অসাধু ডিলার এসব চাল ও আটা ভোক্তাদের না দিয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন বাজারে বা ব্যবসায়ীর কাছে।
ফলে গত সোমবার দিনাজপুর শহরের পাটুয়াপাড়ার এক বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ডিলারদের কাছে দেওয়া খাদ্য বিভাগের ৫১ বস্তা চাল ও ১৯ বস্তা আটা।
প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের মনিটরিং কর্মকর্তা/কর্মচারী দায়িত্বরত থাকার পরও কিভাবে এই চাল ও আটা বাইরে বিক্রি হলো- এক প্রশ্নের জবাবে দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী বলেন, শুধু ডিলার নয়, খাদ্য বিভাগের কোন মনিটরিং কর্মকর্তা-কর্মচারীরও কোনো গাফিলাতি বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ জন্যই চাল ও আটা উদ্ধারের পর নিয়মিত মামলার পাশাপাশি খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে দিনাজপুরের সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেকে এবং অপর দুইজন সদস্য হলেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি) ফিরোজ মোস্তফা ও দিনাজপুর সিএসডির কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক নুরে আলম।
এ কমিটিকে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্তে কোনো ডিলার বা মনিটরিং কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।