Logo
Logo
×

সারাদেশ

যেভাবে কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক কুজেন্দ্র ত্রিপুরা

Icon

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৫ এএম

যেভাবে কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক কুজেন্দ্র ত্রিপুরা

ফাইল ছবি

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। কুজেন্দ্র ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরার নামে অবৈধ উপায়ে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।পাশাপাশি নারী, কেলেঙ্কারি, মদ ও জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ রয়েছে এই সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।

খাগড়াছড়ির মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন কুজেন্দ্র। তার কথায় যেন শেষ কথা। গত ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে সাংবাদিকদের সামনে প্রতিপক্ষকে কীভাবে ঘায়েল করা হবে সে হুংকার দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে দিনব্যাপী তার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি শহরে তাণ্ডব চলে। ভাঙচুরের পর আগুন দেওয়া হয় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়ার বাসভবনে।

যেভাবে উত্থান

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার বাসিন্দা। চাকরি জীবনে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে এনজিওর একটি গ্রাম প্রকল্পের কর্মচারী। পরে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি থাকাকালে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মাথায় ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। চেয়ারম্যান হওয়ার পরই জেলা পরিষদকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। তার হাত ধরেই জেলা পরিষদে নিয়োগ বাণিজ্য, খাদ্যশস্য লুটসহ নানা অনিয়মের সূচনা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীন সব বিভাগেই মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেন তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নানা অনিয়মে জড়ান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ আর অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে মাত্র সাড়ে তিন বছরেই শত কোটি টাকার মালিক হন তিনি। অবৈধ টাকার প্রভাবে ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তৎকালীন এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ১৯ ভোটে হারিয়ে দখলে নেন সভাপতির পদ। ২০১৩ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে হয়ে যান সংসদ-সদস্য। এরপর আর কেউই ঠেকাতে পারেনি তাকে। সমানতালে চলতে থাকে তার অপরাধ, অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্য। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পান তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আরও বাড়ে তার অপরাধ-অনিয়মের দৌরাত্ম্য। নিজের স্বজনদের বড় বড় পদে বসিয়ে পুরো জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তার অপরাধের সহযোগী ছিলেন আপন ভাজিতি জামাতা জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু। আরেক ভাতিজি জামাতা রামগড় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী। তাদের মাধ্যমেই অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন মূর্তমান আতঙ্ক কুজেন্দ্র লাল। অবৈধ টাকার বলে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হন। এরপরই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন।

সম্পদের পাহাড়

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুর, খবংপুরিয়ায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সরকারি খাস জমি দখল করে আলুটিলা পর্যটন এলাকায় খাস্রাং রিসোর্ট, রাঙামাটির সাজেক ভ্যালির কংলাক পাড়ায় ৪ দশমিক শূন্য ৮ একর ভূমির ওপর খাস্রাং নামে রিসোর্টে বিনিয়োগ করেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। নামে-বেনামে খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, রামগড় ও পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলায় রয়েছে জমি। ঢাকার উত্তরায় তার তিনটি দামি ফ্ল্যাট ও পূর্বাচলে রয়েছে কোটি টাকার জমি। বেসরকারি হাসপাতালেও মোটা অঙ্কের অংশীদারিত্ব রয়েছে তার। সরকারি প্রকল্প হাতিয়ে কৃষি খামার ও মৎস্য খামার গড়ে তুলেছিলেন। অবৈধ কাঠ ব্যবসা এবং অবৈধ বালু ব্যবসাসহ নানা খাতে শক্তিশালী সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছিলেন।

বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর, মোটাদাগের সঞ্চয় এবং নিজের পাশাপাশি স্ত্রীর নামেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও স্বর্ণালংকার। তবে এত সম্পদের মালিক বনে যাওয়া কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নির্বাচনি হলফনামায় সম্পদের সিকিভাগও উল্লেখ করেননি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায় গত ১০ বছরে তার আয় বেড়েছে ১৩ গুণ। তবে প্রকৃত হিসাব আরও অন্তত ২০ গুণের বেশি হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম