লালমোহনে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কোটি টাকা কারসাজি
জসিম জনি, লালমোহন (ভোলা)
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৫ পিএম
লালমোহন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বরাদ্দ এলেও তা জানানো হতো না প্রধান শিক্ষকদের। গত অর্থবছরে এমন প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দের তথ্য প্রধান শিক্ষকদের অগোচরে রাখেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন।
কয়েকজন প্রধান শিক্ষক অর্থ বরাদ্দের চিঠি অনলাইন থেকে বের করে শিক্ষা অফিসারকে চাপ দিলে তিনি ডিসেম্বর মাস থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের টাকা ফেরত দিতে শুরু করেন। প্রধান শিক্ষকদের অভিযোগ বিদ্যালয়ের নামে রুটিন মেইনট্যানেন্স, ফুটবল টুর্নামেন্ট, স্লিপসহ অনেক বরাদ্দ আসে। এসব টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন স্কুলের অ্যাকাউন্টে না দিয়ে নিজের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে নিয়ে রাখেন বলে জানান প্রধান শিক্ষকরা।
তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনিয়মের অভিযোগ ও বিভাগীয় তদন্তের সংবাদ গত ৮ জানুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশ হয়। এরপর ১৬ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে তাকে সিলেটের গোয়াইনঘাটে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে তাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয় বদলির আদেশপত্রে।
প্রধান শিক্ষকদের অভিযোগ, শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন লালমোহনে যোগদানের পর বিগত সাড়ে ৩ বছরে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। দায়িত্বে থাকাকালে শিক্ষকরা মুখ খুলতে সাহস না পেলেও এবার বদলির আদেশের পর মুখ খুলছেন কিছু শিক্ষক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আক্তারুজ্জামান মিলনের বদলির আদেশের পর শিক্ষকদের স্ট্যাটাস চোখে পড়ছে। এক প্রধান শিক্ষক লিখেছেন- ‘লালমোহন প্রাথমিক শিক্ষা অফিস আংশিক রাহুমুক্ত হয়েছে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমাদের উপজেলা থেকে একটা অমানুষ বিদায় হলো।’ অন্য এক পোস্টে আরেকজন প্রধান শিক্ষক শুকরিয়া আদায় করে লিখেছেন, ‘আমরা দালালমুক্ত ও ঘুসমুক্ত শিক্ষকবান্ধব শিক্ষা অফিস এবং অফিসের চৌকাঠ পরিবর্তন চেয়েছিলাম, ইনশাআল্লাহ হয়ে গেছে।’
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন বিগত অর্থবছরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দকৃত প্রায় কোটি টাকা নয়ছয় করে শিক্ষকদের বুঝ দিয়েছেন। নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা বরাদ্দ এনে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিতরণ করেননি। গত অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ হয়েছে এমন প্রমাণ নিয়ে প্রধান শিক্ষকরা শিক্ষা অফিসারের কাছে গেলে গত ডিসেম্বর থেকে ওই টাকা ফেরত দিতে শুরু করেছেন তিনি। রুটিন মেইনট্যানেন্স বাবদ ৪০ হাজার টাকা করে ৭টি স্কুলের নামে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে অর্থ ছাড় হয়। ওই ৭টি প্রতিষ্ঠানের ৩টিকে সময়মতো দিলেও বাকি ৪টির টাকা দেননি। পরে প্রধান শিক্ষকরা খবর পেয়ে গত নভেম্বর মাসে শিক্ষা অফিসারের কাছে গেলে ওই টাকা দিতে শুরু করেন।
স্লিপের বরাদ্দ নিয়েও চরম অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য তিনি ৩শত এর উপর শিক্ষার্থী না থাকলেও ৯৮টি স্কুলে ৩০১ থেকে ৬০০ শিক্ষার্থীর ক্যাটাগরিতে দেখিয়ে প্রতিটির জন্য ১ লাখ ৫ হাজার ৭৫৯ টাকা বরাদ্দ আনেন। অথচ ৩০০ এর কম শিক্ষার্থী বিশিষ্ট স্কুলের জন্য বরাদ্দ হয় ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা। তবে অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দ আনলেও ওই বাড়তি টাকা বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠানে দেননি। এই অর্থ ছাড় হয় গত ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে।
একইভাবে শিক্ষার্থী অনুপাতে অতিরিক্ত স্লিপ বরাদ্দ খাত থেকে আরো ১৪টি স্কুলের জন্য তিনি ৩০০ এর উপর শিক্ষার্থী ক্যাটাগরি দেখিয়ে ৫টি স্কুলের ৩০ হাজার করে দেড় লাখ টাকারও হদিস নেই। ১১ জুন ২০২৪ তারিখে এই অর্থ ছাড় হয়। ক্ষুদ্র মেরামত এর জন্য ১৪টি স্কুলের নামে ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ হয়। ওই টাকার বড় একটি অংশ রেখে দিয়ে ১২টি বিতরণ করলেও এখন পর্যন্ত ২টি স্কুলের টাকাই দেননি তিনি।
অন্যদিকে ২০২৪ সালে ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য ২১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে ২ হাজার টাকা করে বরাদ্দ হয়। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য বরাদ্দ ৪ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা। উপজেলা পর্যায়ে এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য বরাদ্দ হয় আরও ৪০ হাজার টাকা। এসব অর্থ গত বছরেই ছাড় হয়; কিন্তু এই টুর্নামেন্ট না হওয়ায় এই টাকার কী হয়েছে তা বলতে পারছেন না কেউই। ৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াস ব্লক মেরামতের জন্য ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ আসে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এই অর্থ ছাড়ও হয়, কিন্তু এই অর্থও বিতরণ করেননি বলে জানান প্রধান শিক্ষকরা। এসব টাকা গত অর্থবছরের জুনের আগেই ছাড় হলেও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জানানো হয়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের কাছে থেকে জানতে চাইলে তিনি জানান, সব ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই। তবে অফিস সহকারী রিয়াজ উদ্দিন জানান, যেসব বরাদ্দ হয়েছে তার চেক দেওয়া হয়েছে প্রধান শিক্ষকদের। অবিতরণকৃত অর্থ চালানের মাধ্যমে ফেরত দেওয়া হয়েছে।