
প্রিন্ট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৫ এএম
ভাতিজাকে হত্যার মাধ্যমে অপরাধ জগতে পা রাখেন যুবলীগ নেতা আলহাজ

বগুড়া ব্যুরো
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৯ পিএম

আরও পড়ুন
বগুড়া শহরের মোস্ট ওয়ান্টেড, তিনটি হত্যাসহ আট মামলার আসামি জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আলহাজ শেখ (৫৫) নিজ ভাতিজা কসবোকে ছুরিকাঘাতে হত্যা ও ১১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে পা রাখেন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে যুবলীগের পদ বাগিয়ে নেওয়ায় তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে দুটি হত্যাসহ চারটি মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। চাঁদাবাজি, দখলসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে কয়েক বছরে কোটিপতি হয়েছেন। শহরের সূত্রাপুর এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনীতিক ও সাধারণ জনগণ জানান, আলহাজ শেখ বগুড়া শহরের সূত্রাপুর এলাকার মৃত মুনসুর শেখের ছেলে। পারিবারিকভাবে শ্যালোমেশিন, পাওয়ার টিলার ও যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী ছিলেন। আবাসন প্লট বিক্রি ও ঠিকাদারি ব্যবসাও রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে আপন ভাতিজা কসবোকে ছুরিকাঘাতে হত্যা ও ১১ লাখ টাকা ছিনতাই মামলার আসামি হন। আলহাজ শেখের এটাই অপরাধের হাতেখড়ি বলে ধরা হয়। পরবর্তীতে তদবিরের মাধ্যমে এ মামলা থেকে রেহাই পান।
বগুড়ায় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে ১৯৯৭ সালে জেলা যুবলীগে স্থান পান। সেই সময় জেলা যুবলীগের সভাপতি মঞ্জরুল আলম মোহন ও সাধারণ সম্পাদক সাগর কুমার রায়ের কমিটিতে সহ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি হন। প্রভাব খাটিয়ে বগুড়া পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পরে পৌরসভার ২নং প্যানেল মেয়র হন। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল মেশিনারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
দলীয় ক্ষমতার জোরে আলহাজ শেখ চাঁদাবাজি, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। পুরো গোহাইল রোড, সূত্রাপুর এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তিনি তার বাহিনীর ভয়ে সকলে আতঙ্কিত থাকতেন। ক্ষমতার দাপটে তার বাড়ির পাশের একটি দোকান দখল করে নেন। হাউজিং ব্যবসার জন্য প্রতিবেশীর বাড়ি অংশ দখল করেন।
ক্ষতিগ্রস্তরা অনেক দেনদরবার করেও দোকান ও জায়গা ফিরে পাননি। তিনি শহরের সূত্রাপুর এলাকায় নিজ বাড়িতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে টর্চারসেল খোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে ভিন্নমতের লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করতেন। পৌরসভার প্যানেল মেয়র হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন বড় বড় ভবনের প্ল্যান পাশ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অবৈধ উপার্জনে নিজেকে জড়ান।
তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে দখল ও অন্যান্য বাণিজ্য অব্যাহত রাখেন। শহরের সেউজগাড়ি এলাকায় বিশাল এলাকা নামমাত্র মূল্যে কেনেন। আবাসিক এলাকা হিসেবে প্রতি শতক ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে বলে প্রচারণা রয়েছে। নানা অসাধু উপায়ে উপার্জন করে তিনি কোটিপতিদের খাতায় নাম লেখান।
গত ২০২০ সালের ৫ জুন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হানিফ মিস্টারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যায় জড়িত থাকায় নিহতের বাবা আলহাজ শেখকে আসামি করেন। তদবিরের মাধ্যমে নিজের নাম কেটে নিয়ে ওই হত্যা মামলা থেকে রেহাই পান। ভয়ে মিস্টারের বাবা এ ব্যাপারি নারাজি দেওয়ার সাহস করেননি।
এদিকে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আলহাজ শেখ তিনটি হত্যাসহ আটটি মামলার এজাহার নামীয় আসামি হন। এরপর অন্যান্য নেতাদের মতো আলহাজ শেখও আত্মগোপন করেন।
পরবর্তীতে শোনা যায়, তিনি বগুড়া শহরের সূত্রাপুর এলাকায় নিজ বাড়িতেই থাকছেন। এর বিনিময়ে প্রতিপক্ষ দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের দুই কোটি টাকা ঘুস দিয়েছেন। এ ঘুসের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতার কপাল পুড়েছে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু ও অন্যরা দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করলেও আলহাজ শেখকে পালাতে হয়নি। তিনি কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই তার অপরাধমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন।
অন্যদিকে ডিবি ও থানা পুলিশ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বিভিন্ন হত্যা ও নাশকতার মামলার এজাহার নামীয় ও সন্দিগ্ধ আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও আসামি হোক বা না হোক তাকে আটক করে মারপিটের পর পুলিশে দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
আলহাজ শেখ তার শহরের সূত্রাপুরের বহুতল বাসভবনে আছেন গোপনে এমন খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের ইনচার্জ ডিবি ওসি ইকবাল বাহারের নেতৃত্বে একদল ফোর্স মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে অভিযান চালান। এ সময় দরজা না খোলায় ও বিশাল নয়তলা ভবনের কোথায় তিনি আছেন তা নিশ্চিত করতে পুলিশ দলকে বেশ বেগ পেতে হয়। একপর্যায়ে তিনি তার নয়তলা ভবন থেকে পাশের সাততলা ভবনে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করেন; কিন্তু পুলিশ তৎপর থাকায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে রাত ৩টার দিকে সাততলা ভবনের একটি ফ্লাটে আলহাজ শেখের অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। দরজা ভেঙে ফেলার কথা বললে খুলে দেওয়া হয়। তখন পুলিশ সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে নেয়। আলহাজ শেখকে গ্রেফতারে এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখা দিয়েছে।
বগুড়ার ডিবি ওসি ইকবাল বাহার ও এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, যুবলীগ নেতা আলহাজ শেখের বিরুদ্ধে আগের দুটি হত্যাসহ ৪-৫টি মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তিনি ৫ আগস্টের পর তিনটি হত্যাসহ আটটি মামলার এজাহারনামীয় আসামি। বগুড়া সদরের আকাশতারা গ্রামের কমর উদ্দিন বাঙ্গী হত্যা মামলায় তাকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত শুনানি শেষে তাকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাকে রিমান্ডে এনে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।