থমকে যেতে বসেছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক মুকলেসুরের সংসারের চাকা!
জাফর আহমেদ, টাঙ্গাইল
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০০ এএম
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইংরেজি শিক্ষক মুকলেসুর রহমান। মাত্র আড়াই বছর বয়সেই তিনি দৃষ্টি হারান টাইফয়েড জ্বরে। দুচোখে পৃথিবী না দেখলেও যানবাহনে ফেরি করে চকলেট বিক্রি করে এসএসসি, বই বিক্রি করে এইচএসসি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন। অর্জন করেছেন ১০ম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদও। তবুও প্রায় এক যুগেও শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় মেলেনি একখানা চাকরি।
২০২৩ সালে তিনি টাঙ্গাইলের বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সম্প্রতি তার সেই চাকরিটিও আর থাকছে না আগামী মাস থেকে। তাহলে কী থমকে যাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইংরেজি শিক্ষক মুকলেসুর রহমানের সংসারের চাকা?
মুকলেসুর রহমান বলেন, আমার জীবনের কুড়িটা বছর পড়াশোনা ও ১০টা বছর চাকরির পেছনে ঘুরেছি। ১০ লাখ টাকা ঘুষ না দেওয়ায় আমার চাকরি হয়নি। সরকারের নীতিহীনতা, আইনের অপ্রয়োগ ও ভুল প্রদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কারণে আমাদের মতো অসহায়দের চাকরি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীদের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। আমরা যারা প্রতিবন্ধী রয়েছি, তারা সব সময় বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ক কোনো উপদেষ্টা বা কমিশন নাই। প্রতিবন্ধীদের চরম বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে একজন করে প্রতিবন্ধী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধীরা মাস্টার্স শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কাজ পায়।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ইংরেজি এই শিক্ষক বলেন, বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসি) আওতায় সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্প চলমান। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে সেখানে প্রায় আট বছর যাবত শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না। সেখানেও যদি আমাকে নিয়োগ দেওয়া হতো, তাহলেও অনেক উপকার হতো। আমি জীবনে আর কোনো দিন ভিক্ষা করবো না। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
মুকলেসুর রহমান আরও বলেন, ২০২৩ সালে এনটিআরসিএ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছি। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সেখানে কোনো কোটা না থাকায় আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি তো বাংলাদেশের নাগরিক। সরকারি আইন যদি আমাদের বিপক্ষে কাজ করে, তাহলে আর কিছুই করার নাই।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে বলা আছে, যদি কোনো প্রতিবন্ধী কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, তাকে বাদ দেওয়া যাবে না। যদি বাদ দিতে হয়, তাহলে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুকলেসুর রহমান গাজীপুরের নাগা এলাকার আবুল মনসুরের ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। প্রায় তিন বছর যাবত টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকা মুন্সিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। তার একমাত্র ছেলে আব্দুল মারসিফুল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র প্রদীপ কুমার শীল বলেন, মুকলেসুর রহমান স্যার অনেক ভালো ক্লাশ নেন। তাকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে রাখা জরুরি বলে আমি মনে করি।
বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, একজনকে রাখতে গেলে আরও আট জনকে রাখতে হবে। এই আটজনকে রাখতে প্রতিষ্ঠানের মাসে এক লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়। সেই খরচ কমাতে মুকলেসুরদের বাদ দেওয়া হয়েছে। মুকলেসুর যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়, সেজন্য তাকে আরও এক মাস আগে ছুটি দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে মুকলেসুর রহমানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ঘাটতি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। তাই তার মতো আট জন খণ্ডকালীন শিক্ষককে বাদ দেওয়া হয়েছে।