Logo
Logo
×

সারাদেশ

এক্সপ্রেসওয়ে যেন মরণফাঁদ: ৫ বছরে প্রাণ ঝরেছে দুই শতাধিক

Icon

আবু জাফর, কেরানীগঞ্জ

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ পিএম

এক্সপ্রেসওয়ে যেন মরণফাঁদ: ৫ বছরে প্রাণ ঝরেছে দুই শতাধিক

দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মহাসড়কটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল।

২০২০ সালের মার্চ মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে মহাসড়কটিতে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। কথা ছিল, এটি রাজধানীতে যাতায়াত সহজ করবে। কিন্তু তা না করে উল্টো এই এক্সপ্রেসওয়ে পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।

উদ্বোধনের পর ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৬৭ জন।

২০২২ সালে দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয় ১৯৬টি, এতে ৭৪ জন নিহত ও ২৬৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮৫ জন আহত হয়েছেন। মারা গেছেন ২২ জন। যার মধ্যে চলতি ডিসেম্বরেই মারা গেছে ১০ জন।

হাইওয়ে পুলিশের তথ্যানুসারে, গত সপ্তাহে এই এক্সপ্রেসওয়েতে অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। ফলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধন পর থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত পৌনে ৫ বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। আহতের সংখ্যা হাজারের বেশি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকাল-দুপুর-রাত, কুয়াশা, ঝড়-বৃষ্টি সব সময় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় চালকরা। বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেলগুলোই বেশি এমন করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরাতেই এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে কুয়াশা পড়ছে। কুয়াশার কারণে কিছু গাড়ি ধীরে চলে, কিছু গাড়ির গতিসীমার বাইরে বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছে। এতে করে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটে প্রাণহানি হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে পুলিশের নজরদারি জোরালো না থাকায় চালকরা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। এ সব বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বাসচাপায় দুই পরিবারের ৬ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৫ জন। হতাহতরা প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের যাত্রী ছিলেন।

২২ ডিসেম্বর ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাসাড়া এলাকা পর্যন্ত কুয়াশার মধ্যে বেপরোয়া গতিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার জায়গায় ৪টি স্থানে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ডভ্যানসহ ১০টি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসব গাড়ি কোথাও সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা দেয়। কোথাও একটি গাড়ি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনায় মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক গাড়িচালক মারা যান।

এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা এক্সপ্রেসওয়েটি সাইন-সংকেত ব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। নেই সিসিটিভি।

এসব দুর্ঘটনার ধরন হচ্ছে, ঘন কুয়াশার কারণে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে পেছন থেকে একের পর এক যান এসে ধাক্কা দেয়। একে ‘পাইল আপ’ বলে। এ জন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।

মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর এলাকার বাসিন্দা শিপলু  জানান, কুচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা, হাসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানা এলাকার কাছাকাছি এক্সপ্রেসওয়েতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নামমাত্র টহল দেয়। কুয়াশাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে পুলিশসহ সড়কের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জোরালো আইন প্রয়োগ করা দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি বসানো দরকার। সড়ক আইন মানে না এমন চালকদের ও পরিবহণ মালিকদের বিচারের আওতায় আনা দরকার, তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, এসব দুর্ঘটনা ঘন কুয়াশায় ফগ লাইট না জ্বালানো, ট্রাফিক আইন না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের গাফলতি, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র গাড়ি থামানো, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় বের করার কারণে ঘটেছে। এসব ঘটনা রাতের আঁধারে, ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির মধ্যে বেশি হয়েছে। ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালানো, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষিত করা ও যাত্রীরা সচেতন হলেই এই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

পুলিশের টহলদারি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী জানান, প্রতিদিন রাতে দুটি গাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীর টোলপ্লাজা থেকে শুরু করে মাওয়া এলাকার প্রায় ২৯.২ কিলোমিটার এলাকায় টহল দিচ্ছেন তারা। সে সময় চালকদের বারবার ট্রাফিক আইন মেনে এবং কম গতিতে গাড়ি চালাতে বলা হচ্ছে। পুলিশের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও পুলিশ দূরে চলে গেলে আবার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা। এর ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।

হাসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বারবার সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে আরও বলেন, রোববার ও সোমবার যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে দুটোই ভোর বেলা ঘটেছে। আর এ সময় অতিরিক্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে এক্সপ্রেসওয়ে। দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে। সড়ক আইন মেনে যদি চালকরা গাড়ি চালাতেন তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না।

বেপরোয়া চালক ও পরিবহণের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আইনি কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে দুর্ঘটনা রোধে প্রতিনিয়ত আইনের মাধ্যমে জরিমানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম