আমুর ছত্রছায়ায় অঢেল সম্পদের মালিক সোহেল গাজী
তরিকুল ইসলাম রতন, বরগুনা
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪২ পিএম
বরগুনা সদর উপজেলার ১ নম্বর বদরখালী ইউনিয়নের ড্যামা এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম সোহেল গাজী (৩০) ওরফে মটু গাজী প্রথমে একটি মোবাইল দোকানে কাজ করতেন। পরে তিনি বরগুনার পৌর মার্কেটে গাজী টেলিকম নামে নিজেই একটি দোকান চালু করেন।
একপর্যায়ে অনেক টাকা ঋণী হয়ে পড়েন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে মটু গাজী কাজের সন্ধানে ঢাকায় যান। পরে সেখানে একটি চাকরি নিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। হঠাৎ তিনি আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সঙ্গে ঢাকায় সোহেল গাজীর পরিচয় হয়। পরে তার বাসায় আসা-যাওয়া করতে করতে সোহেল গাজী বিশ্বস্ততা অর্জন করেন এবং আমির হোসেন আমুর বাসার সব বাজার-ঘাট তিনিই করতেন।
তাছাড়া বরগুনা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির সাগরের বড় বড় মাছ আমির হোসেন আমুর বাসায় নিয়ে যেতেন মটু গাজী। এভাবে তিনি তার বিশ্বস্ত হয়ে অবৈধ উপায়ে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।
গত ১০ বছর আগে বরগুনার চরকলোনি পুলিশ সুপারের বাস ভবনের অপজিটে কোডেক গলিতে জীর্ণশীর্ণ একটি টিনের ঘরে কোনোমতে থাকতেন সোহেল গাজী ও তার পরিবার। এখন সেখানে ৩৮ শতক জমি কিনে গড়েছেন বিশাল এক আলিশান বাড়ি।
বরগুনা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে তার প্লট, সদর উপজেলার ৬নং খেজুরতলা মৌজায় ১ একর ৭৬ শতাংশ ফসলি জমি ক্রয় করেন। ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে স্পেলেনডোর নামে তার রয়েছে পঞ্চমতলা বিশিষ্ট এক আলিশান বাড়ি, ঢাকার নিকুঞ্জ খিলক্ষেতে তার অর্থায়নে চলে সিটি ব্যাংক শাখা, ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডে দ্য এলিট রেসিডেন্স নামে আবাসিক হোটেল, ঢাকা উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় রয়েছে গাড়ির শোরুম, ঢাকার মহাখালীতে রয়েছে আইসক্রিম ফ্যাক্টরি এবং ঢাকায় চাইনিজ হোটেলসহ নামে-বেনামে রয়েছে তার নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তিন ভাই বোনের মধ্যে সোহেল গাজী দ্বিতীয়। বড় ভাই লিটুকেও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছেন তিনি। একমাত্র বোন মুমুকে ডাক্তারি পড়ার সব খরচ চালান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, এই সাইফুল ইসলাম সোহেল গাজী বরগুনা পৌর মার্কেটের একটি মোবাইলের দোকানে কাজ করতেন। পরে গাজী টেলিকম নামে নিজে একটি দোকান দিয়েছিলেন। দোকান দিয়ে অনেক ঋণী হয়ে ঢাকায় যান। এখন তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে রয়েছে তার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
তারা আরও জানান, এই সোহেল গাজী এক সময় বাজার করতে পারত না। এখন তিনি বাজারে মাছ কিনলে এক-দেড় লাখ টাকার মাছ একত্রে কিনেন। কিভাবে তিনি এত টাকার মালিক হইছে আমাদের মাথায় কাজ করে না। এই টাকার উৎস কোথায় আমাদের জানা নেই। শুনেছি বরগুনায় সে আলিশান বাড়ি করেছে। ঢাকার উত্তরায় তার ফ্লাট ও নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে।
স্থানীয় বারেক নামের তার এক চাচা জানান, বরগুনায় সোহেল ব্যবসা করত, এক সময় অনেক টাকা ঋণী হয়ে যায়। পরে ঢাকায় গিয়ে এমপি আমির হোসেন আমুর পিএস হিসেবে চাকরি নেয়। এখন তিনি অনেক টাকার মালিক হয়েছে। গত ১ বছর আগে ফরহাদ এমপি তার বাড়ির পাশে ২০৪ শতাংশ জমি ১ কোটি ০৯ লাখ টাকায় ক্রয় করেন।
উত্তরায় পরিবহণ বাস কাউন্টারের জাহিদ নামের এক টিকেট বিক্রেতা জানান, একদিন লাবিবা পরিবহণে ঢাকা থেকে আমি বাড়িতে যাই। একই গাড়িতে আমার পাশের সিটে বসে এই মটু গাজী বরগুনায় গিয়েছিলেন। তখন গাড়িতে বসে সংক্ষেপে সে তার জীবন ইতিহাস আমাকে বলেন। তিনি জানান, এক সময় তিনি নাকি বরগুনায় ব্যবসা করে অনেক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরে মাত্র ১৫ টাকা নিয়ে মটু গাজী ঢাকায় আসেন। এখন তিনি নাকি অঢেল সম্পদের মালিক।
বরগুনা পৌর মার্কেটের রুনা মেডিকেল হলের স্বত্বাধিকারী মো. হামিদ বলেন, সোহেল গাজী ওরফে মটু গাজী জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। বরগুনায় তিনি মোবাইলের দোকান দিয়ে ঋণী হয়ে পড়েন। পরে ঢাকা গিয়ে অনেক কষ্ট করে সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু তার পিএস হিসেবে কাজ পায় এবং সেখান থেকেই তার উত্থান হয়। এমনকি আমু ও তার পরিবারের সব আত্মীয়স্বজনের বাজার এই মটু গাজীই করতেন। সেখান থেকে তিনি অনেক টাকার মালিক হন। তাছাড়া ওদের চরকলোনিতে একটি জমি ছিল। বাদশা কনট্রাক্টরের কাছ থেকে সুদে অনেক টাকা নিয়েছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় চরকলোনির জমি নিলামে ওঠে। পরে নিলামের সেই জমি মটু সোহেল আবার ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে তার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং সেখানে অনেক কর্মচারী কাজ করছেন। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গাড়ির শোরুম, রিসোর্ট, আইসক্রিমের ব্যবসা ও আবাসিক হোটেলসহ অনেক কিছু।
এছাড়াও ঢাকায় তার নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বরগুনায়ও তার বেশ সম্পত্তি রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সে এখন অনেক টাকার মালিক।
তিনি আরও জানান, সরকারি ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য মটু গাজী অনেক ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন। যাতে কেউ ওকে ডিস্টার্ব করতে না পারে। তাছাড়া উত্তরা চেরাগআলী কামারপাড়ায় তার গাড়ির শোরুম এবং ঢাকায় তার আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আছে। বর্তমানে তিনি অনেক টাকার মালিক হয়েছেন।
এসব সম্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম সোহেল গাজী ওরফে মটু গাজী যুগান্তরকে জানান, ঢাকায় তার দাবুদা নামের একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, বরগুনায় ১ একর ৩৬ শতাংশের একটি প্লট ও সদর থানার পেছনে ২ কাঠার একটি প্লট এবং মাছের ব্যবসা রয়েছে। তিনি বরগুনা থেকে মাছ এনে ঢাকায় সাপ্লাই দেন।
তিনি আরও জানান, ঢাকার উত্তরায় যে এলিট রেসিডেন্সিয়াল হোটেল ও গাড়ির শোরুম, উত্তরায় ফ্ল্যাট আছে সেগুলো তার না। তিনি শুধু দেখাশোনা করেন, এগুলো তার এক আঙ্কেলের নামে।
তাছাড়া বরগুনায় ৩৮ শতক জমিতে যে ভবন রয়েছে সেটা তার মামা করে দিয়েছেন। আরও কিছু জানতে হলে আপনারা অনুসন্ধান করেন।