Logo
Logo
×

সারাদেশ

ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘জোর করে’ হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বক্তব্য ভাইরাল!

Icon

শাহীদুল ইসলাম শাহী, নড়াইল

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ পিএম

ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘জোর করে’ হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বক্তব্য ভাইরাল!

ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে একের পর এক ‘জোর করে’ মিথ্যা বিবৃতি এবং অপতথ্য প্রচারের ঘটনা চলছে। সম্প্রতি, ভারতের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিন্ন দুটি ভিডিওতে নড়াইলের দুই নারী দাবি করেছেন, ‘হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, সবাই পালাচ্ছে। পূজা অর্চনাসহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।’

এসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে উভয় নারী স্বীকার করেছেন যে, তারা ভারতীয় গণমাধ্যমের চাপে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এর ফলে তাদের পরিবার, প্রতিবেশীরা এবং স্থানীয় হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নের বোড়ামারা (সিকদারপাড়া) গ্রামের অরবিন্দু বিশ্বাসের স্ত্রী খুকুরানী বিশ্বাস। গত ২ ডিসেম্বর তিনি বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে যান তার ভাইয়ের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আটকের পর তার অনুসারীদের বিক্ষোভের মধ্যে চট্টগ্রামে বিএনপি-জামায়াতপন্থি এক আইনজীবী নিহত হন। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে দেশে ইসকনের কার্যক্রম নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে; যা ভারতীয় গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এ সময় পেট্রাপোল সীমান্তে তার সাক্ষাৎকারটি নেয় ভারতের একটি বাংলা সংবাদ চ্যানেল এবিপি আনন্দ।

ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা নিয়ে ওই সাক্ষাৎকারে খুকুরানী বিশ্বাস বলেন, ‘তার বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইলে। হিন্দু ও ইসকনরা সমস্যায় আছে। বর্তমানে এখানে ঠিকমতো পূজা অর্চনাসহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। শঙ্খ বা কাসা বাজালে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং ভারতে চলে যাচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে হিন্দুদের কোনো স্থান নেই, বাংলাদেশে শুধুমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। তারা জীবনের নিরাপত্তা হীনতায় আছেন বলেও দাবি করা হয়’।

ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুকুরানী বিশ্বাসের ওই বক্তব্য ব্যাপক ঝড় তোলে এবং ভাইরাল হয়েছে।

তবে এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে জানা যায়, ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে মিথ্যা-ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়ে অপপ্রচার করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খুকুরানী বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয়রা।

খুকুরানী বিশ্বাসের ছেলে অমলেন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘আমার মা ভারতীয় গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি আমি সবটুকু শুনেছি। আমি ওই বক্তব্য দেখার পর মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি, মা জানিয়েছেন তাকে ভারতীয় সাংবাদিকরা বলেছেন এ কথা বললে বাংলাদেশের হিন্দু বা ইসকনদের ভালো হবে। তাকে ভুল বুঝিয়ে এবং প্ররোচিত করে তার কাছ থেকে একপ্রকার জোর করে এমন বক্তব্য নিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্য বলে মত দেন তিনি।’

এ সময় ছেলের মোবাইল ফোনের ভিডিও কলে ভারতে অবস্থানরত খুকুরানী বিশ্বাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবি করেন, ‘আমি যা বলেছি ভুল করে বলেছি। বাংলাদেশি হিসেবে আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

খুকুরানী বিশ্বাসের এক প্রতিবেশী হরিচাঁদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা এখানে দীর্ঘকাল বংশ পরস্পরায় একত্রে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছি। কখনও কারোর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ কিংবা হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেনি। আমাদের এলাকায় নিয়মিত পূজা-পার্বণে মুসলিম প্রতিবেশীরা সহযোগিতা করে থাকেন। ভারতের গণমাধ্যমে দেওয়া খুকুরানীর বক্তব্য একেবারেই মিথ্যা এবং বানোয়ট। হঠাৎ তার এমন বিতর্কিত বক্তব্যে এলাকাবাসী ও তার পরিবারের সদস্যরাও গভীরভাবে লজ্জিত এবং বিব্রত বলেও মত দেন তিনি।’

এদিকে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঊষা রানী রায় নামে নড়াইলের আরেক ষাটোর্ধ হিন্দু নারীকে একই কায়দায় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের শেখানে মিথ্যা ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে অপপ্রচার চালায়।

তবে ঊষা রানী ভারত থেকে এক ভিডিও বার্তায় জানান, সাংবাদিকরা তাকে আটকে রেখে বাধ্য করে মিথ্যা কথা বলতে।

ভারতের বাংলা সংবাদ চ্যানেল এবিপি আনন্দে প্রচার হওয়া ঊষা রানী রায়ের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে সরেজমিনে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার নলদী ইউনিয়নের চাকুলিয়া গ্রামে গিয়ে পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ গ্রামের মধ্যপাড়ার বাসিন্দা গ্রাম্য চিকিৎসক সুবাস রায়ের স্ত্রী সাবেক সংরক্ষিত ইউপি সদস্য ঊষা রানী গত ৬ ডিসেম্বর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যান। সেখানে বেনাপোল ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ওপারে পৌঁছতেই তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের খপ্পরে পড়েন। তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ৪ ঘণ্টা আটকে রেখে বাধ্য করা হয় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের মিথ্যা বক্তব্য দিতে।

এ সময় ওই নারী ভারতীয় গণমাধ্যমে ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে তারা জামায়াত শিবির ও বিএনপির বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে আছেন।’

ঊষা রানী আরও বলেন, তার বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইলে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ দেখেছি। তখন পাকিস্তানীরা ও রাজাকারদের যেসব কর্মকাণ্ডে যা না দেখেছি। এবার তা দেখছি এই যে জামায়াত-শিবির বিএনপিরা সামনের উপর দিয়ে যা করছে, কথাগুলো তো সমস্ত বলা যাবে না। আবার ফিরে তো বাংলাদেশে যেতে হবে।...আতঙ্কে আছি আমরা। কথা বলা বারণ। আবার মাঝে মধ্যে শুনি মেয়েদের বোরকা পরে, ওই যে কি যেন হিজাব দেয় মুসলমানরা, ওইভাবে চলতে হবে। বোরকা পরে স্কুলে যেতে এই সব। এরপর থেকে তার ওই বক্তব্যের ভিডিওটি ভাইরাল হয়।

এদিকে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা-ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রচার করায় বিস্ময় প্রকাশ এবং বিব্রত বোধ করেছেন ঊষা রানী রায়ের পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয়রা।

ঊষা রানী রায়ের স্বামী সুবাস বাবু রায় বলেন, ‘আমার স্ত্রী ১৮ বছর ধরে নলদী ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য ছিলেন। সে ভারতীয় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন লোকের চাপে পড়ে ভয়ে বাধ্য হয়ে এ ধরনের কথা বলেছে। আমাদের এখানে ওই ধরনের কোনো সমস্যা বা কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’

বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত ঊষা রানী রায় মোবাইল ফোনে জানান, ‘বর্ডার থেকে ভারতীয় সাংবাদিকরা আমাকে ৪ ঘণ্টা আটকিয়ে রেখে জোর করে এসব কথা বলিয়েছে। আমি একা ছিলাম, ভয়তে পড়ে ওরা যা শিখিয়ে দিয়েছে-আমি সেইসব কথা বলেছি। আমরা তো বাংলাদেশে খুব ভালো আছি। বাংলাদেশে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আমাকে জোর করে ওই কথা বলাইছে। আমি খুব দুঃখ পেয়েছি।’

নলদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ পাখি বলেন, ‘পূর্ব পুরুষের আমল থেকেই এখানে হিন্দু-মুসলমান পরস্পর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে শান্তিতে বসবাস করছে। আমার জানামতে, এই ইউনিয়নের কোথাও হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এখানে সবাই মিলেমিশে আছি। গেল দুর্গাপূজায় জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির নেতারা এলাকার বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পাহারা দিয়েছেন। আমার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ঊষা রানী রায়কে ভারতের মিডিয়া জোর করে মিথ্যা বক্তব্য দিতে বাধ্য করেছেন বলে আমরা জেনেছি।’ 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সদর থানার ওসি সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘খুকুরানী বিশ্বাস নামে এক নারীর ভাইরাল হওয়া ভিডিও বক্তব্য আমরা দেখেছি। এরপর বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে খোঁজখবর নিয়েছি। ওই এলাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যা ওই নারী ভারতের মিডিয়াতে বলেছেন। কেউ তাকে প্রভাবিত করে ওই বক্তব্য নিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম