Logo
Logo
×

সারাদেশ

রাঙামাটি থেকে সুনামগঞ্জ পদে পদে দুর্নীতি

ঘুস দুর্নীতিতে বেপরোয়া শাল্লার শিক্ষা অফিসার

Icon

হাবিব সরোয়ার আজাদ, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ)

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০০ পিএম

ঘুস দুর্নীতিতে বেপরোয়া শাল্লার শিক্ষা অফিসার

ঘুসবাণিজ্য, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম।

দাপ্তরিক সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ২০২২ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ‘শাস্তিমূলক’ বদলি করা হয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামকে।

মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ‘দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হওয়ার পরও’ এই শিক্ষা কর্মকর্তা শাল্লায় বদলি হয়ে আসার পর থেকেই পুরনো কায়দায় আবারো ঘুস বাণিজ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার সহ নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

খোলস পাল্টে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন সময়ে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা ও আওয়ামী শিক্ষক বলয়ের জন চারেক সিন্ডিকেট শিক্ষক নেতাদের নিয়ে নিজের আখের গোছাতে একটি বলয় তৈরি করেন ওই শিক্ষা অফিসার। সিন্ডিকেট করে সাধারণ শিক্ষকদের জিম্মি করে নানাভাবে অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের উপজেলা পর্যায়ের দাপুটে নেতার ঘনিষ্ঠজন বনে দলীয় ক্যাডারের মতো শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

এখন ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের’ কব্জা করে ফের নতুন বলয় তৈরি করে সাধারণ শিক্ষকদের চাকরির গ্যাঁড়াকলের ফাঁদে ফেলে ঘুস বাণিজ্য চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন ওই শিক্ষা অফিসার।

রোববার শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষক, তাদের পরিবার ও এলাকাবাসী জানান, শাল্লায় যোগদানের পর থেকে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম কয়েকজন শিক্ষক নেতাকে নিয়ে তিনি ‘অনেকটা প্রকাশ্যেই’ দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছেন। এই শিক্ষক নেতাদের মাধ্যমেই সাধারণ শিক্ষকদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে ঘুসের টাকা আদায় করে যাচ্ছেন শিক্ষা অফিসার।

শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় সুশীল সমাজের মানুষ জানান, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে শাল্লায় এসে তৎকালীন সময়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন সালাম। মন্ত্রণালয়ের ‘চাকরিচ্যুতির বরখাস্তের আদেশ’ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সান্নিধ্যে চলে যান তিনি। গুঞ্জন রয়েছে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে মোটা অংকের টাকায় বশ করে চাকরিচ্যুতির বদলে ‘দুই ধাপ অবনমন’ করে রক্ষা পান সালাম।

সালাম যেসব এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবখানেই প্রকাশ্যে দুর্নীতি করে তিরস্কৃত হয়েছেন তিনি, টাকা কামানোই ছিল তার নেশা-পেশা।

রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা সদরে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণিত হলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। ওই স্মারকে তাকে দুই ধাপ অবনমন করা হয়েছিল প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নির্দেশে। বিগত বাজেটের লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন ও মাথার উপরে আশীর্বাদ হিসেবে উপজেলার দাপুটে নেতা আল আমিন চৌধুরী থাকায় সালাম এরপর ঘুসের তলিতে ভর্তুকির টাকা তুলে নিতে সাধারণ শিক্ষকদের ফাঁক ফোঁকর খুঁজে খুঁজে শাল্লায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন বিদ্যালয়ের তালিকা চায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তালিকার ভিত্তিতে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে পিইডিপি-৪ এর আওতায় এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সি খাতে উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৪টি বিদ্যালয় ২ লাখ টাকা করে ও ১৪টি বিদ্যালয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা সংস্কার বরাদ্দ পায়। সালাম বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে ৪০-৩০ হাজার টাকা করে প্রায় ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এছাড়াও বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামত, প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষা উপকরণ কেনার বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট হারে ঘুস নিয়েছেন। শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ও হাওড় ভাতা ছাড়ের নামেও তিনি প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে ঘুস নিয়েছেন। এছাড়াও অনলাইন বদলি কার্যক্রমে অগ্রবর্তী প্রতিবেদনের জন্য আন্তঃজেলা বদলির আবেদনকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুস নিয়েছেন। যারা ঘুস দেননি তাদের আবেদন বৈধ হলেও তিনি আবেদন অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছেন। এছাড়াও পুরনো কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন তিনি নিয়মানুযায়ী বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিক্রি বিক্রি করে দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্যাঞ্চল রাঙামাটির বরকল উপজেলার শিক্ষকদের বকেয়া বিলের জন্য ১০ শতাংশ টাকা প্রকাশ্যে ঘুস নিয়ে পাহাড়ে আলোচনার জন্ম দেন শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম। গাইবান্ধা সদর ও পাবনার বেড়া উপজেলায় কাজ করার সময়ও এই দুটি স্টেশন থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। পাবনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় তদন্ত শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটি প্রতিটি তদন্তে সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি।

গাইবান্ধার একাধিক শিক্ষক সালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। রাঙামাটির বরকলে গ্রেড উন্নীত করতে গিয়ে শিক্ষকদের বেতনের ১০ শতাংশ ঘুস নিয়েছিলেন সালাম। পাবনার বেড়া উপজেলায় দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের ৩০ শতাংশ ঘুস নিতেন। ২০২১ সালের ২৩ জুন শিক্ষকরা এই অভিযোগে বেড়ায় তার কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন।

গত এক দশকে অধিদপ্তর দুর্নীতির জন্য তাকে শাস্তিমূলক বদলি করেছে একাধিকবার।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গায় কাজ করার সময় দুর্নীতির কারণে ১৫ শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ২০১০ সালে সালাম এই উপজেলায় থাকাকালে ব্যাক ডেটে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শুন্যপদে নিয়োগ প্রদান করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। 

তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ওই শিক্ষকদের নিয়োগ আটকে দিয়েছিল। তদন্ত কমিটি সালামের এই দুর্নীতিকে ‘শাস্তিযোগ্য’ বলে মতামত দিয়েছিল।

নিয়োগ বঞ্চিতরা এ ঘটনায় সচিব, মন্ত্রী ও অধিদপ্তরে সালামের দুর্নীতির অভিযোগ করেন। 

অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপপরিচালক ড. জয়নুল আবেদিনকে বালিয়াডাঙ্গা উপজেলায় এসে তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিনি অফিসে এসে সালামের তৈরি কাগজপত্র জব্দ করেন। ড. জয়নুল আবেদিনের তদন্তে নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়টি আবারো প্রমাণিত হয়।

গাইবান্ধা সদরে দায়িত্ব পালনকালে ৩০টি বিদ্যালয়ের স্লিপ ফান্ডের দুর্নীতির কারণে শিক্ষকরা অভিযোগ লিখিত অভিযোগ করেন। প্রাক প্রাথমিক, ক্ষুদ্র মেরামত, নতুন শিক্ষকদের জিপিএফ ফান্ড খোলার জন্য টাকা আদায়, ল্যাপটপ বিতরণের জন্য কমিশন, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ছাড়ের জন্য টাকা, ২০১৮ মলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় পোষ্য কোটার প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল সালামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।

সুনামগঞ্জের শাল্লায় তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ করায় দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলার আবেদন করেছেন গত জুলাই মাসে সালাম।

স্থানীয় সাংবাদিক আমির হোসেন গত ২৪ অক্টোবর নিরাপত্তা চেয়ে সালামের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। আলাদাভাবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক শিক্ষার্থী গত ২১ অক্টোবর শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত আবেদন করেন।

ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার গত ২৪ অক্টোবর তদন্ত করেন। গত ২২ অক্টোবর স্থানীয় সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিক সমাজ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এই ঘটনায় এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম তার ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সিন্ডিকেটের নেতা সুব্রত ও অরবিন্দুর সঙ্গে কথা বলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের ডাক দেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে সালাম মানববন্ধন বিরত রাখেন। এই দুই শিক্ষক নেতার প্রশ্রয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন সালাম।

রোববার নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাল্লার হবিবপুর ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘গুগলে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামের দুর্নীতি’ লিখে সার্চ দিলে শত শত নিউজ আসে। এত দুর্নীতি করে তিনি কিভাবে রেহাই পান ভাবলেই আঁতকে উঠি। সম্প্রতি তার বিদ্যালয়ে বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত বরাদ্দের টাকা থেকে  ৪০ হাজার টাকা ঘুস নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

শাল্লার বাহাড়া ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমিও ৪০ হাজার টাকা ঘুস দিয়েছি শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামকে। না দিয়ে উপায় ছিল না। 

যতগুলো স্কুল বরাদ্দ পেয়েছে সবাইকেই ৩০-৪০ হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। আমাদের হাত পা বাধা তাই কথা বলতে পারছি না। প্রতিবাদ করলে ৪-৫ জনের শিক্ষক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হুমকি ধমকি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

রোববার শাল্লা উপজেলা বিএনপির সভাপতি গণেন্দ্র চন্দ্র সরকার বলেন, শুনেছি এই শিক্ষা অফিসার যেখানে গেছেন সেখানেই দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন। শাল্লাতেও শাস্তিমূলক বদলি হয়ে এসেছিলেন। এখানে এসেও নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে ডুবে থাকায় তার বিরুদ্ধে ছাত্র জনতা বিক্ষোভ করেছেন।

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মাহবুব জামান বলেন, শাল্লা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে নানা ঘুস দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।

অভিযুক্ত শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয় আমাকে শাস্তি দিলেও আমি আপিল করে রায় পক্ষে পেয়েছি। আমি দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত নই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম